কক্সবাজার

যে কারণে সিনহাকে হত্যা করা হয়

কক্সবাজার, ০১ ফেব্রুয়ারি – কক্সবাজারের টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার পেটোয়া বাহিনীর নানা অপকর্ম জেনে ফেলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এসব তথ্য ফাঁস হলে নিজের পেশাগত জীবনের ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই সিনহাকে হত্যার ছক তৈরি করেন প্রদীপ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে সিনহাকে হত্যা করা হয়।

কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেনাবাহিনীর মেজর পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের পর ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলের ধরার জন্য কাজ করছিলেন সিনহা। এ কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছিলেন তিনি।

এরই ধারাবাহিকতায় টেকনাফ গিয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার বাহিনীর নানা অপকর্ম জেনে ফেলেন সিনহা। আর এ জন্য প্রদীপের দৃষ্টিতে পড়েন তিনি।

সিনহা হত্যা মামলাটি তদন্ত করেন কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। প্রায় এক বছরের শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩১ জানুয়ারি আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। সবশেষ বহুল আলোচিত এ মামলায় রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে প্রদীপ কুমার ও লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রের ১২ পাতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ খান দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল করার উদ্যোগ নেন। এ চ্যানেলের ডকুমেন্টারি তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। এজন্য তিনি গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে ২০২০ সালের ৭ জুলাই কক্সবাজারের রামু থানাধীন হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্টের একটি কটেজে উঠেন। সেখানে তিনি আশপাশের চিত্রধারণসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং তা ভিডিওচিত্রে ধারণ শুরু করেন।

এরপর সিনহা টেকনাফে একই ধরনের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ শুরু করেন। তখন সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ করার সময় ওসি প্রদীপের মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানায় নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্য জানতে পারেন। নির্যাতনের শিকার অনেক ভিকটিম পরিবারের সদস্য সিনহা এবং তার সহযোগীদের কাছে প্রদীপের অত্যাচারের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন। এসব শুনে সিনহা এবং তার সহযোগীরা ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী এবং তাদের পেটুয়া বাহিনীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

এসব কাজের একপর্যায়ে ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ, শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের দেখা হয়ে যায়। তখন তাদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ ভিডিও ধারণের নানা সরঞ্জাম ছিল। তারা ওসি প্রদীপের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন প্রদীপ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।

ওসি প্রদীপ এও বলেন, তিনি মেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। এসময় প্রদীপ সিনহাদের ভয়ভীতি দেখান, হুমকি দেন এবং কক্সবাজার ছেড়ে যেতে বলেন।

প্রদীপ তাদের হুমকি দিয়ে বলেন, ইন্টারভিউ, ভিডিওচিত্র বানিয়ে ইউটিউবে প্রচার করে তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং কর্তৃপক্ষকে জানালে মেজর সাহেব ও তাদের ধ্বংস করে দেবেন। এরপর ওসি প্রদীপ তার থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন ও গোপন বৈঠক করেন।

অভিযোগপত্রের একই পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, ওসি প্রদীপের হুমকির বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সিনহা এবং তার সঙ্গীরা নিলীমা রিসোর্টে অবস্থান করেই প্রামাণ্যচিত্রের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তারা কক্সবাজার না ছাড়ায় ওসি প্রদীপের সন্দেহ হয় যে, সিনহা সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার পরিচয় দিয়ে টেকনাফে তার নানা কুকর্মের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ভিকটিম পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছেন।

এসব অপকর্মের বিষয়গুলো প্রচার হলে তার চাকরির বিরাট ক্ষতি হবে অনুমান করে বিষয়টি তিনি বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে জানান।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী তাদের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ এবং আসামি মো. নিজাম উদ্দিনের মাধ্যমে সিনহা এবং তার সঙ্গীদের সম্পর্কে খবর নেওয়ার চেষ্টা করেন।

অভিযোগপত্রের ১৩ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে মো. লিয়াকত আলী পুলিশের সোর্সদের সিনহা এবং তার ভিডিও দলকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সিনহা মো. রাশেদ।

হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) দুই নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে (৩০) তিন নম্বর আসামি করা হয়।

বাকি ছয় আসামি হলেন- উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন র‌্যাবকে।

সূত্র : জাগো নিউজ
এন এইচ, ০১ ফেব্রুয়ারি

Back to top button