জাতীয়

ফের গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ

ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি – গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া হিসেবে গণশুনানি হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত না হলেও গতকাল কমিশনের সদস্যরা অনির্ধারিত একটি বৈঠক করে। পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাব আরও সুনির্দিষ্ট করতে তাদের চিঠি দেওয়া হবে বলে বিইআরসির এক কমিশন সদস্য জানিয়েছেন।

গত দশ বছরে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। গত দুই বছর ধরে মহামারী করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় আবার গ্যাস বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, আমরা শুরু থেকে বলে আসছি সরকারের ভুলনীতি এবং দুর্নীতির কারণেই বারবার গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে কঠিন করে তোলা হচ্ছে। মূল্য বৃদ্ধির এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানে না। তিনি বলেন, ভুলনীতির ওপর চলছে জ¦ালানি খাত।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, কমিশনে পাঠানো গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে পেট্রোবাংলা কমিশনে চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠির পক্ষে আরও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রয়োজন। সে বিষয়ে অবহিত করে পেট্রোবাংলাকে কমিশন চিঠি দিবে। দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া হিসেবে গণশুনানি কবে হবে সেই বিষয়ে এখনো বিইআরসি সিদ্ধান্ত নেয়নি।

এদিকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত সপ্তাহে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা দেয় পিডিবি। তবে পিডিবির প্রস্তাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় প্রস্তাব ফেরত পাঠানো হয়। এখন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্তাব চূড়ান্ত করছে পিডিবি।

দেশে চলমান গ্যাস সংকটে দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলের পাশাপাশি কয়লার ব্যবহার। সম্প্রতি ফার্নেস তেল আমদানিতে শুল্ক কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। কয়লা আমদানিতে বসানো হয়েছে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট। বাড়ানো হয়েছে ডিজেলের দাম।

পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, যে পরিমাণ গ্যাস দরকার, সেটা তো দিতে পারছে না। বিশ^বাজারে এলএনজি এবং জ্বালানি তেলের দামও বাড়ছে। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে রেকর্ড লোকসান হয়েছে। এ বছরও তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ আরও কমার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের অভাবের কারণে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। সরকারের নির্দেশে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে গ্রাহককে বিদ্যুৎ দিতে হয়। ফলে প্রতিবছর একটা ঘাটতি থেকেই যায়। জ¦ালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর ত্রিশ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতি হবে- এমন হিসাব কষে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ফলে সেই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিতে হবে কমিশনকে।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির জন্য পিডিবির একটি আবেদন পেয়েছি। কিন্তু তা প্রবিধান অনুযায়ী হয়নি। ফলে পরদিনই ফেরত পাঠিয়েছি। বিধি মোতাবেক ফের প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে।

পিডিবির দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়াতে হয়েছে। অথচ গত জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ বাবদ খরচ ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। এতে গত অর্থবছর শুধু জ্বালানি বাবদ ব্যয় ৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩ টাকা ১৬ পয়সা জ¦ালানি খরচ হয়। আগের অর্থবছর ২০১৯-২০ এ ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিটে ২ টাকা ১৩ পয়সা।

এদিকে গত জুলাইয়ে কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও কয়লার দাম বাড়ছে। সব ধরনের জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং গ্যাস সরবরাহ আরও কমে যাওয়ায় চলতি ২০২২ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট জ্বালানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪ টাকা ২৪ পয়সা। জ¦ালানি বাবদ মোট ব্যয় বাড়বে ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের তুলনায় তা তিন ভাগের এক ভাগের চেয়ে বেশি হবে।

চলতি বছর বিতরণকারী সংস্থা- কোম্পানিগুলোর কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে আট হাজার ৮৯৯ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট। এদিকে গ্যাসের দাম না বাড়লে বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির ব্যয় হবে ৭৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হবে ৪৩ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৫৮ পয়সায় কিনে পাঁচ টাকা আট পয়সায় বিক্রি করবে পিডিবি। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির ফলে চলতি বছর পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে ৩০ হাজার ২৫২ কোটি টাকা।

এ ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের পাইকারি দাম আট টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণের আবেদন করেছে পিডিবি। অর্থাৎ বিদ্যুতের পাইকারি দাম প্রতি কিলোওয়াটে সাড়ে তিন টাকা বা ৬৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। পাইকারি দাম বৃদ্ধির হারের অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়াতে হবে।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে বিইআরসি, যা ওই বছর ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর খুচরা বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হলেও পাইকারি মূল্য বাড়ানো হয়নি। বর্ধিত মূল্য ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়।

২০১৫ সালে পাইকারি বিদ্যুতের মূল্য ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়।

সূত্র : আমাদের সময়
এন এইচ, ২৭ জানুয়ারি

Back to top button