পরিবেশ

জলবায়ু প্রকল্পে অনিয়ম: ফল গাছ আছে মাত্র ১০ শতাংশ

শাহেদ শফিক

জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) নিয়েছে সরকার। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতির গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু অনিয়মের কারণে সুফল মেলেনি। এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

সিআরপিএআরপি প্রকল্পে ৯০ শতাংশ ফল গাছ রোপণের কথা থাকলেও লাগানো হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। বাকিসব পরিবেশ বিধ্বংসী আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রোপণ করা গাছও নষ্ট হওয়ার পথে। উপকূলীয় বন বিভাগগুলোতে সরেজমিনে অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট দফতরের নথিপত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বনায়ন পদ্ধতি এবং প্রজাতি নির্বাচনে জলবায়ু সহিষ্ণুতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।

প্রকল্প বাস্তবায়ন ম্যানুয়াল (পিআইএম) অনুযায়ী, সেগুন, গর্জন, মেহগনি, আমলকি, হরিতকি, বহেরার মতো প্রজাতির মাধ্যমে ‘কোর জোন’ এবং কেওড়া, গেওয়া ও বায়েন প্রজাতির মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করতে হবে। এ ছাড়া কড়ই, গামার, চিকরাশি, অর্জুন, জলপাই, হরিতকি, আমলকি, আকাশমনিসহ বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রজাতির মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক ‘বাফার জোন’, ‘নন-ম্যানগ্রোভ বাফার জোন’, ‘স্ট্রিপ’ এবং ‘মাউন্ড’ বনায়ন করতে হবে। এতে আকাশমনির সংখ্যা ১০ শতাংশের কম থাকবে।

কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির বনায়নে প্রজাতির বৈচিত্র্য রক্ষা করা হয়নি। ‘বাফার জোন’, ‘ননম্যানগ্রোভ বাফার জোন’, ‘স্ট্রিপ’ এবং ‘মাউন্ড’ বনায়নে গুটিকয়েক স্বল্পমেয়াদি প্রজাতির চারা রোপণ করা হয়েছে। প্রাধান্য পেয়েছে আকাশমনি। এ গাছ ১০ শতাংশের কম হওয়ার কথা থাকলেও ৯০ শতাংশের বেশি লাগানো হয়েছে। অধিকাংশ স্ট্রিপ বনায়নেও ৪০ শতাংশের বেশি আকাশমনি দেখা গেছে। বিষয়টি স্বীকারও করেছে বন বিভাগ।

প্রকল্পের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণমূলক সামাজিক বনায়নে স্বল্পমেয়াদে আর্থিক উপকার পাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদের সঙ্গে চুক্তির শর্তানুযায়ী বনায়নের মেয়াদ মাত্র ১০ বছর। এরপর এসব বনভূমি কেটে ফেলা হবে—এমনই আশঙ্কা বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। এতে এ বনায়ন দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু সহিষ্ণুতা অর্জন করবে না বলে মনে করছেন তারা।

গাছের বর্তমান অবস্থা

বন অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুসারে, সিআরপিএআরপি প্রকল্পের আওতায় ২০১৩-২০১৬ সময়কালে সাড়ে ১৭ হাজার হেক্টর ব্লক বাগান এবং দুই হাজার কিলোমিটার সিডলিং (সিডিং ট্রে দিয়ে চারা রোপণ) স্ট্রিপ বাগান লাগানো হয়েছে।

সামাজিক বনায়নের আওতায় ২০১৩-২০১৭ সালে লাগানো বনের মধ্যে ছয় হাজার ৩৫০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ কেওড়া, গেওয়া ও বায়েন গাছ লাগানো হয়। এর দুই হাজার ২০০ হেক্টর নোয়াখালীতে। যার বিশাল অংশ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গেছে। বাফার-জোন বনায়ন করা হয়েছে সাত হাজার ৪২৫ হেক্টর। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি আকাশমনিসহ অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি প্রজাতির গাছ রয়েছে। যা মোট ব্লক বাগানের ৪২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

প্রকল্পের আওতায় নন ম্যানগ্রোভ বাগান ২৭৮ হেক্টর। এর ৮০ শতাংশই আকাশমনি। মাউন্ড বনায়নের ১৫৫ হেক্টর জমিতেও ৯০ শতাংশের বেশি আকাশমনি ও স্বল্পমেয়াদি প্রজাতির গাছ। স্ট্রিপ (রাস্তার পাশে ও বাঁধে) বনায়ন করা হয়েছে এক হাজার ৫৭ কিলোমিটার। এগুলোও স্বল্পমেয়াদি। সামাজিক বনায়ন হওয়ায় বাগান সৃজনের ১০ বছরের পর এগুলো কেটে ফেলা হবে বলে জানা গেছে।

এদিকে প্রকল্প শেষের পর থেকেই বরাদ্দের অভাবে বনায়নের এলাকায় রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধ রয়েছে। যার কারণে চারাগুলোর বেঁচে থাকাই দায়। সামাজিক বনায়নের আওতায় সৃজিত বাফার জোন ও মাউন্ড প্ল্যান্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বনায়নে অংশগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদেরই হওয়ার কথা। কিন্তু বন রক্ষায় তারা কোনও কাজই করছেন না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাসিয়াখালি মানিকপুর ও কক্সবাজার দক্ষিণ (টেকনাফ), চট্টগ্রাম উত্তর (শীতলপুর), বরদুয়ারা ও ডলুসহ আরও অনেক স্থানে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির আওতায় ‘বাফার জোন’ বনায়ন করা হয়েছে। এ বনায়নের জন্য কোনও ‘বাগান ব্যবস্থাপনা কমিটি’ করা হয়নি।

বন বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, বনায়নে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতির যথাযথ অনুপাত ও বৈচিত্র্য রক্ষা করা হয়নি। যে কারণে বনের স্থায়িত্ব ও জলবায়ু অভিযোজন হুমকিতে পড়বে।

এ অবস্থায় কিছু সুপারিশ করেছেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বনায়নে দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু অভিযোজন নিশ্চিত করতে জলবায়ু সহিষ্ণু উদ্ভিদের অনুপাত বজায় রাখতে হবে। অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির বনায়নে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ আবর্তনের বৃক্ষের অনুপাত ঠিক রাখা প্রয়োজন। এ জন্য দীর্ঘস্থায়ী বনায়নকে প্রাধান্য দিতে হবে। উপকারভোগীরা যাতে আগ্রহ নিয়ে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করেন সেটাও নিশ্চিত করবেন বন অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।’

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের প্রথম পরিচালক উত্তম কুমার সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপকারভোগীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সুফল পাওয়ার প্রত্যাশায় আকাশমনি রোপণ করা হয়েছিল। আমি এখন অবসরে। তবে ওই সময় অভিযোগ ওঠার পর অনেক বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এর পর কী হয়েছে তা আর জানা নেই।’

জানতে চাইলে বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইং-এর উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফল গাছ যে কী সেটা আগে জানতে হবে। বণ্যপ্রাণীর খাবারের জন্য অর্জুন, আমলকি, চালতা, কেওড়া লাগানো হয়। আমরা শতভাগ বনজ গাছ লাগিয়েছি। অভিযোগগুলোর সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কাজের কোনও সম্পর্ক নেই।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা রীতিমতো প্রতারণা এবং দুর্নীতি।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অবশ্যই এর তদন্ত করবো। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে এমন অনিয়ম আর হবে না।’

এন এইচ, ৩০ ডিসেম্বর

Back to top button