জাতীয়

বিএনপিতে পরিবর্তনের হাওয়া, আতঙ্কে নেতারা

সালমান তারেক শাকিল

ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর – দলের ‘গুরুত্বপূর্ণ ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ নেতাদের অব্যাহতির কারণে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি দুই জন প্রভাবশালী নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কারণে সিনিয়র নেতাদের মাঝে নতুন করে দুশ্চিন্তা ভর করেছে। তবে এই প্রক্রিয়াটিকে ‘নতুন নেতৃত্বের পরিবর্তনের হাওয়া’ বলে জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীলরা।

শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে খুলনার প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্তে তার অব্যাহতির খবরে পুরো দলেই নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে।

শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) ও রবিবার (২৬ ডিসেম্বর) বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা মনে করছেন, নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে হঠাৎ করেই। বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে কোনও আলোচনা হয়নি। তবে কোনও নেতাই স্বনামে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কোনও কোনও সিনিয়র নেতা ‘মন্তব্য করতে রাজি নন’, এ বিষয়টিও স্বনামে উদ্ধৃত হতে সম্মতি দেননি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমি তো এ বিষয় জানি না। না জেনে আন্দাজে বলা ঠিক হবে না।’

দলের প্রভাবশালী এক নেতার দাবি, লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকায় যাদের সঙ্গে কথা বলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন—তাদের পক্ষ থেকেও তাকে (তারেক রহমান) মঞ্জুকে অব্যাহতি না দিয়ে ভিন্ন কোনও উপায় গ্রহণ করার বিষয়ে কোনও ব্রিফ করা হয়নি।

বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, হঠাৎ করেই দলে ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার কারণে প্রথমত সাংগঠনিকভাবে বিএনপির ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল পুরো তৃণমূল পর্যন্ত দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে সুবিধা পাবে। তৃতীয়ত, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে, তারাই দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে ভুল বুঝিয়ে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাচ্ছেন। এসব সিদ্ধান্তের কারণে স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও চিন্তায় আছেন। আতঙ্কে আছেন। কেউ কিছু বলছেন না। এতে আদতে কার ক্ষতি?

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল দলের স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদুল ইসলামের একটি বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে বলেন, তিনি বলেছিলেন ‘যিনি গাছ রোপণ করেন, তিনি যদি গাছকে রক্তাক্ত হতে দেখেন, তাহলে তারই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়।’

বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত অক্টোবরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলীয় কার্যক্রমে তার যুক্ততা কম থাকার কারণে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ৩ নভেম্বর বরিশাল নগরীর নতুন কমিটি থেকে যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ারকে বাদ দেওয়া হয়।

নেতারা বলছেন, মেয়র মনিরুল হক সাক্কু স্থানীয় ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বরিশালের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত মজিবুর রহমান সরোয়ার। নজরুল ইসলাম মঞ্জুও খুলনার রাজনীতিতে প্রভাবশালী। বড় কোনও ত্রুটি ছাড়া তাদের বাদ দেওয়ার কারণে সাংগঠনিকভাবে ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। এর প্রভাব দলীয়ভাবেই টের পাবে বিএনপি।

ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা জানান, ২০১৯ সালে ছাত্রদলের ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর আজ অবধি তাদের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি।

নজরুল ইসলাম মঞ্জুসহ সম্প্রতি গ্রহণযোগ্য নেতাদের অব্যাহতি দেওয়ার কারণে বিএনপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা, এমন প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এটার দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। তিনি কোনও ব্যাপারে অসঙ্গতি দেখে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হয়তো। আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা নেই। আমি কোনও মন্তব্য করতে পারবো না।’

গত ৯ ডিসেম্বর অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনাকে আহ্বায়ক, তরিকুল ইসলাম জহিরকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মো. শফিকুল আলম তুহিনকে সদস্য সচিব করে খুলনা মহানগরীতে নতুন কমিটি করে বিএনপি। প্রায় ২৯ বছর পর নগর কমিটির নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ে ১২ ডিসেম্বর অনুসারীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু।

খুলনায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নজরুল ইসলামকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী রকিবুল ইসলাম বকুল। হাওয়া ভবন সংশ্লিষ্ট এই নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে খুলনা মহানগরীর কমিটিতে বকুলের অনুসারীরা জায়গা পেয়েছেন। এই কমিটির নেতারা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগর লবীরও কাছের বলে জানান স্থানীয় নেতারা। যদিও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন আলী আসগর লবী।

স্থানীয় বিএনপির কোনও কোনও নেতার ভাষ্য—নজরুল ইসলাম মঞ্জুও দলের দায়িত্বে আসার পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোনও সুযোগ দেননি। আলী আসগর লবী বা রকিবুল ইসলাম বকুলকেও খুব একটা পাত্তা দিতেন না তিনি। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত একাধিক দায়িত্বশীল জানান, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো ‘পরিবর্তনের হাওয়া’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে যারা অ্যাডজাস্ট করতে পারবে, তারাই থাকবে।’

দায়িত্বশীল একজনের ভাষ্য, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার পর তারেক রহমানের হাত ধরে বিএনপি এখন তৃতীয় জেনারেশনের নেতৃত্বে। সম্প্রতি সিদ্ধান্তগুলো শীর্ষ পর্যায় থেকে নতুন ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতের ফলাফল এখনই স্পষ্ট হবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য মনে করছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঠিক কী চাইছেন, তা স্পষ্ট নয়। যে কারণে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অস্পষ্টতা কাজ করছে।

উল্লেখ্য, সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) রাত ৮টায় স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এম এস, ২৭ ডিসেম্বর

Back to top button