জাতীয়

বাড়তে পারে গ্যাস-বিদ‌্যুৎ-সারের দাম

কেএমএ হাসনাত

ঢাকা, ২৬ ডিসেম্বর – বাজেট ভর্তুকির রাশ টানতে গ‌্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এরআগে জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বাড়ানো হয়েছিল।

গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম সমন্বয় বা না বাড়ালে বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় বাড়বে। যার পরিমাণ হতে পারে জিডিপির ২ শতাংশ। ফলে টাকার অঙ্কে ভর্তুকি ব্যয় বাজেটে প্রক্ষেপণের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যেতে পারে। সে কারণে অন্ততপক্ষে গ‌্যাস ও বিদ্যুতের দাম দ্রুত বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (২২ ডিসেম্বর) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটি’র বৈঠকে অর্থ বিভাগ থেকে দাম সমন্বয়ের এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরমার্শ দিয়েছেন। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ বাবদ ৪৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

সূত্র জানায়, বাজেট মনিটরিং সভায় আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার সম্পর্কিত একটি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটে প্রাথমিক আকার ধরা হয়েছে ছয় লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

সভা সূত্রে জানা গেছে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় রয়েছে। রেমিট্যান্স ছাড়া, আমদানি, রপ্তানি, এডিপি বাস্তবায়ন ও রাজস্ব আদায়ের হার ভালো রয়েছে। কিন্তু সার্বিক ভর্তুকি ব্যয় কমানোর জন্য বিদ্যুৎ, সার ও গ্যাসের দাম সমন্বয় (বৃদ্ধি) করার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে বাজেটের ওপর চাপ বেড়ে গিয়ে আর্থিক খাত একটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। তাই সারের দাম না হলেও গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম যেন আগামী বছরের শুরুতেই সমন্বয় করা হয় সে ব‌্যাপারে আলোচনা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দাম সমন্বয় করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার প্রয়োজন হবে। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দ্রুতই নেওয়া হবে।

দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে কি না এমন প্রশ্নে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘দাম বাড়ানোর পর মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ধীরে ধীরে তা কমে আসে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা আদৌ চিন্তিত নই। আমাদের চিন্তা ভর্তুকি নিয়ে। ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে গেলে অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়বে তা সামলানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হবে।’

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সরকার গত ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ২৩ শতাংশ বা ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ফলে এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। তখন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে এবং এই ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকার দাম সমন্বয় করেছে।

তখন আরও বলা হয়েছিল, বর্তমান ক্রয়মূল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ডিজেলে লিটার ১৩ দশমিক ০১ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে লিটার প্রতি ৬ দশমিক ২১ টাকা কমে বিক্রি করায় প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসেই ৭২৬ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তবে জ্বালানি তেলে যে অঙ্কের লোকসান হয় বলে দাবি করা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি তেল থেকে শুল্ক আদায় করা হয়।

সরকার যখন তেলের দাম বৃদ্ধি করে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ব্যারেল প্রতি ৮০ ডলারের কাছাকাছি ছিল। তারপর থেকেই বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে তেলের দাম কমতে শুরু করে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমতে পারে এমন খবর জানা যায় নভেম্বর মাসে। প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারে বৃদ্ধির পর গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করে। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দর কমেছে চার শতাংশের বেশি। তবে তার প্রভাব দেশের জ্বালানি তেলের দামে পড়েনি। তেলের দাম কমানো তো দূরের কথা বরং এখনন আবার বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে।

গত মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম কমেছে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ বা ৩ দশমিক ৪১ মার্কিন ডলার। এদিন প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই বিক্রি হয়েছে ৬৭ দশমিক ৪৫ ডলারে।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বজুড়ে ওমিক্রন সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকা এবং ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক বিধিনিষেধ ফিরে আসায় আবারও তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী।

এদিকে সিটি ব্যাংক এনএ’র এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীন সম্মিলিতভাবে ১০ কোটি থেকে ১২ কোটি ব্যারেল তেল ছাড়তে পারে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে চার কোটি থেকে ছয় কোটি ব্যারেল, চীন তিন কোটি ব্যারেল, ভারত ৫০ লাখ ব্যারেল এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এক কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়তে পারে।

সিটি ব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আগামী জানুয়ারি মাসে এই তেল বাজারে ছাড়া হলে বাজারে দৈনিক অতিরিক্ত তেল সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ ব্যারেল। এতে বাজার তেলে সয়লাব হয়ে যাবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই দাম আরও কমে আসার কথা। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও সরকার এখনো দেশের বাজারে তেলের দাম কমায়নি। উপরন্তু বিপিসি প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি করে দুই টাকা করে মুনাফাও করছে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ টন। তার মধ্যে ডিজেল ৫০ লাখ টন। ডিজেলের ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে। সেচকাজে ব্যবহৃত হয় ১৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬ শতাংশ ডিজেল চালিত।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। এর ফলে আবাসিক খাত থেকে শুরু করে পরিবহন ও শিল্প খাতের মতো অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় বেড়ে যায়।

আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা এবং এক চুলার খরচ ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গৃহস্থালী মিটারে দাম বেড়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৯.১০ টাকা থেকে ১২.৬০ টাকা। সিএনজির ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে। এতে দাম বেড়েছে ৭.৫ শতাংশ।

এছাড়া বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনের জন্য, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাটপিভ পাওয়ার, শিল্প ও চা বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গড়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭.৩৮ টাকা থেকে ২.৪২ টাকা বাড়িয়ে ৯.৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গড়ে দাম বেড়েছে ৩২.০৮ শতাংশ।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। এসময় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৫.৩ শতাংশ। এবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কী হারে বাড়ানো হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের কথা এখনও জানা যায়নি।

সূত্র : রাইজিংবিডি
এন এইচ, ২৬ ডিসেম্বর

Back to top button