ব্যক্তিত্ব

কিশোর সন্তানকে সাহায্য করুন স্ট্রেস মোকাবেলায়- জানুন এনএলপি বিশেষজ্ঞের মত

একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে জটিল সময় যায় তার কিশোর বয়সে। প্রচুর তথ্য আসতে থাকে তাদের কাছে, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সামনে আসতে থাকে, আসতে থাকে এতদিন না জানা অনেক তথ্য। তখন যেমন সাহসে ভর করে অনেক কিছুই করে ফেলতে ইচ্ছা করে তেমনি আবার অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে প্রচুর। শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে তাদের মনের অবস্থাও বদলে যেতে থাকে। কখনো তারা নিষ্পাপ আচরণ করে, আবার কখনো তাদের আচরণে প্রকাশ পায় অপরাধপ্রবণতা।

সন্তানের এই বয়সে তাদেরকে কীভাবে গাইড করবেন এই বিষয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন সব অভিভাবকই। সন্তানের ভাল চেয়ে অনেক সময়ই বাবা-মা এমন সব সিদ্ধান্ত নেন যা প্রকৃতপক্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সন্তানের মনস্তত্ত্বে। এসময় তাদেরকে বুঝতে পারা খুবই জরুরি। তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান দেওয়া আবার ভুল হলে তাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত না করে সঠিক পথে নিয়ে আসা এই সব দায়িত্বই থাকে অভিভাবকের।

আমাদের সমাজে বাবামায়েররা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে অভ্যস্ত। কিশোর সন্তানের স্বাধীনতা চাওয়া, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করা, সখ্যতা তৈরি করতে চাওয়া, রোমাঞ্চকর কাজে উৎসাহী হওয়া এই সবই স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু বাবা-মায়েরা সন্তান হাতছাড়া হয়ে যাবে বা বিপথে চলে যাবে এই ভয়ে এমন সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন যা তাদেরকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। উভয়পক্ষের জন্যই সময়টা জটিল।

সন্তানের সাথে দুরত্বও তাই বেড়ে যেতে এ সময়। আবার আপনার সঠিক আচরণ আপনাকে তার সবচেয়ে ভাল বন্ধুতেও পরিণত করতে পারে। শুধু তাই নয়, কিশোর বয়সে সঠিক পরিচর্যা আপনার সন্তানের মেধার বিকাশ ঘটায়। এ সময়ই সে খুঁজে পায় জীবনের কাছে তার চাওয়া-পাওয়ার উত্তর। তার সৃজনশীলতাকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে এখান থেকেই শুরু হয় তার অনন্য একজন মানুষ হওয়ার যাত্রা।

জটিল সময়টায় নিজে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মেনে চলুন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। এনএলপি বা নিউরো লিঙ্গুইস্টিক প্রোগ্রামিং যারা অনুশীলন করেন তাদের কাছ থেকে আমরা যুক্তিসঙ্গত দিকনির্দেশনা পেতে পারি। এনএলপি ৩টি বিষয় নিয়ে গবেষণা করে- নিউরোলজি, ভাষা এবং প্রোগ্রামিং। নিউরোলজিকাল সিস্টেম আমাদের শরীরের কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, ভাষা সেটাকে প্রকাশ করে এবং অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। আর প্রোগ্রামিং হল শরীরের ক্রিয়া এবং ভাষা মিলিয়ে আমাদের নিজেদের যে মডেল আমরা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরি। তাহলে এক কথায়, নিউরো লিঙ্গুইস্টিক প্রোগ্রামিং ব্যাখ্যা করে মস্তিষ্ক (নিউরো) এবং ভাষা (লিঙ্গুইস্টিক) এর মৌলিক ডায়নামিক এবং কীভাবে তারা আমাদের শরীর এবং আচরণে প্রভাব ফেলে (প্রোগ্রামিং)।

এন এল পি প্রাক্টিশনার ডা. মেরিয়েট জন্সেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের স্ট্রেস এবং সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের করণীয় নিয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। জেনে নেব সেগুলো-

‘সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর ছেলেমেয়েদের স্ট্রেসের মূল কারণ থাকে স্কুল এবং পরীক্ষা (৭০%), পরিবার এবং তাদের সামাজিক জীবন। ওপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, কিশোর বয়সীরা নিজেদের উদ্বিগ্নতার জন্য ৪টি বিষয়কে দায়ী করেছেন-
১। স্কুলের কাজ (৬৮%)
২। অভিভাবক (৫৬%)
৩। বন্ধুদের সমস্যা (৫২%)
৪। রোমান্টিক সম্পর্ক (৪৮%)

আপনি হয়ত ভাবছেন, আপনার সন্তান সবসময় দূর্ব্যবহার করছে, কথা শুনছে না। এই স্ট্রেসগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে তার আচরণ। আপনিই তাকে সহযোগিতা করতে পারেন। প্রথমেই খেয়াল করুন কোন বিষয়টি বর্তমানে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার সমস্যাকে গুরুত্বহীন মনে করবেন না বা তার কাছে এমন আচরণ করবেন না যাতে তার মনে হয় আপনি ভাবছেন, সে খুব ছোট বিষয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করছে। এতে সে হীনমন্যতায় ভুগবে এবং ভবিষ্যতে আপনার সাথে তার সমস্যা ভাগাভাগি করে নিতে চাইবে না। তাই আন্তরিকভাবে শুনুন এবং সাপোর্ট দিন।

মেনে চলুন এই পরামর্শগুলো
১। পরীক্ষা বা যেকোন বিষয়ে দুশ্চিন্তা হতেই পারে। কিন্তু সেটা মাত্রাতিরিক্ত হলে বুঝিয়ে বলা জরুরি। এমন অনেকেই আছেন যারা পরীক্ষা নিয়ে এতই স্ট্রেসে থাকেন যে পরীক্ষার দিন তাদের জ্বর চলে আসে বা অচেতন হয়ে যান। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আপনার সন্তানকে আগে বুঝুন। এরপর তার সমব্যথী হয়েই বলুন, এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

২। সন্তানকে শরীরচর্চায় উৎসাহী করুন। উৎসাহ দিন গান শুনতে, নিজের হাতে কিছু তৈরি করতে অথবা প্রকৃতির সংস্পর্শে যেতে। এটি তাদের স্ট্রেস কমাবে, হাসিখুশী এবং রিল্যাক্স থাকতে সাহায্য করবে।

৩। স্বাস্থ্যকর খাবার দিন আপনার সন্তানকে। অ্যান্টি-স্ট্রেস অনেক খাবার আছে সেগুলো দিতে পারেন।

৪। স্ট্রেস অনেক সময় পরিণত হয় মানসিক সমস্যায়। আপনার পক্ষে সেটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নাও হতে পারে। অভিজ্ঞ কাউন্সিলার এক্ষেত্রে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাকে নিয়ে যেতে পারেন একজন কাউন্সিলরের কাছে। এমন অনেক কথা যা সে হয়ত আপনার সাথে শেয়ার করছে না, কিন্তু এখানে বলতে পারবে মন খুলে।

৫। আপনার সন্তানকে শেখান কীভাবে চিন্তা করা থামিয়ে মনোযোগ নিয়ে যেতে হয় অন্যদিকে। কাজের প্রতি ফোকাস করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। একে বলা হয় ‘stepping from stress into zen’।

৬। ধ্যান করতে উৎসাহিত করুন। এতে কাজে মনোযোগ দেওয়া, মন স্থির করা, স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে তার হবে। তবে ধ্যান করার অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে। সঠিক পদ্ধতিটি শিখতে হবে।

৭। সবসময় আপনার সন্তানের সাথে হেসে কথা জীবন। তার কাছে জীবনকে একটি যুদ্ধ নয়, তুলে ধরুণ সহজ বিচরণের জায়গা হিসেবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর চর্চা করুন, তাকেও এই চর্চা করতে শেখান।’

কিশোর বয়সে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আপনার সন্তানের জীবন অনেক সহজ হয়ে আসবে। একই সাথে আপনার সাথে তার সম্পর্কও হবে সহজ। নিয়ন্ত্রণ আরোপের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। তার বন্ধু হোন। প্রতিবেশী বা বন্ধু নয়, যে কোন প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শকে গুরুত্ব দিন।

এম ইউ

Back to top button