কক্সবাজার

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুক্কুর-সলেমন বাহিনীর নৃশংসতা

কক্সবাজার, ১৯ ডিসেম্বর – গত ১৭ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ার চাকমারকুল ক্যাম্প-২১-এর সি/৪ ব্লকের সাব মাঝি (ক্যাম্পের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি) সৈয়দ আমিন অপহৃত হন। অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ৮০ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। নানাজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে আমিনের স্ত্রী হাসান বশর ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপরও স্বামীর খোঁজ পাননি তিনি। দীর্ঘদিন তার কোনো খোঁজ মিলছিল না। প্রায় ১১ মাস পর গতকাল শনিবার চাকমারকুল ক্যাম্প থেকে অন্তত ৬ কিলোমিটার দূরে ১৪ নম্বর ক্যাম্পে ইয়াকুব নামে এক রোহিঙ্গার পরিত্যক্ত বাড়ির মেঝে খুঁড়ে একটি কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। পরনে থাকা বেল্ট ও চুল দেখে স্ত্রী শনাক্ত করেছেন এই লাশ তার স্বামী আমিনের। সন্দেহতীতভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা হবে। কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনার সূত্র ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপহরণ, চাঁদাবাজি, নারীর ওপর নিপীড়নসহ নানা অপরাধে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপের তথ্য সামনে এলো। এই গ্রুপের মূল হোতা মো. শুক্কুর ও সলেমন পলাতক। পুলিশের ধারণা, তারা বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান করছেন। জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে ক্যাম্প ছাড়েন তারা। আরসা পরিচয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পে শুক্কুর ও সলেমনের হয়ে কাজ করে এমন ২০-২৫ জন রয়েছে। তবে তারা সত্যি সত্যি আরসার সদস্য এটা মনে করে না বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

কীভাবে শনাক্ত হলো লাশ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, শুক্রবার রাতে উখিয়ার ক্যাম্প থেকে তিন রোহিঙ্গা যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- মো. ইসলাম (২২), আব্দুল মোন্নাফ (২৬) ও মো. ইলিয়াস। অভিযোগ আছে এই তিন রোহিঙ্গা যুবক আরসা পরিচয়ে অনেক দিন ধরেই সাধারণ রোহিঙ্গাদের নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিলেন। একই পরিচয়ে তারা ক্যাম্পও নিয়ন্ত্রণ করতেন। অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা স্বীকার করেন, জানুয়ারি মাসে সৈয়দ আমিনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। এরপর মুক্তিপণের পুরো টাকা না পাওয়ায় তাকে ধরে নেওয়ার ৭/৮ দিন পর হত্যা করা হয়। এরপর লাশ ইয়াকুবের ঘরের মেঝে খুঁড়ে পুঁতে ফেলা হয়। ইয়াকুব পরিবার নিয়ে অনেক আগেই ভাসানচর চলে যাওয়ায় তার ঘরটি পরিত্যক্ত ছিল। এই অপহরণ ও হত্যা মিশনের নেতৃত্বে ছিলেন শুক্কুর ও সলেমন। তিন রোহিঙ্গার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল মাটি খুঁড়ে মিলল কাপড়ে মোড়ানো কঙ্কাল।

হত্যার আরেক কারণ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক মাঝি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ধরনের ‘জিম্মাদার’ প্রথা প্রচলনের চেষ্টা করে কোনো কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ। উখিয়ার ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর ক্যাম্পের জিম্মাদার ছিলেন সলেমন। যারা ক্যাম্পের জিম্মাদার হন তারা চান, ক্যাম্পের যে কোনো বাসিন্দার যে কোনো সমস্যা তারা সমাধান করবেন। মূলত টাকার বিনিময়ে তারা বিচার-সালিশ করে থাকেন। তবে অনেক সময় জিম্মাদারদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান ক্যাম্পের মাঝি ও সাব-মাঝিরা। তারা ক্যাম্প ঘিরে যে কোনো ষড়যন্ত্র ও অপরাধ তৎপরতার তথ্য গোপনে প্রশাসনকে জানিয়ে দেন।

এ কারণে জিম্মাদাররা মাঝি ও সাব-মাঝিদের ক্ষতি করার জন্য টার্গেট করে থাকেন। অপহৃত সৈয়দ আমিন উখিয়ায় একটি ক্যাম্পের সাব-মাঝির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী শুক্কুর ও সলেমনের ধারণা ছিল ক্যাম্পের নানা তথ্য প্রশাসনকে আগেই জানিয়ে দিচ্ছিলেন আমিন। এ কারণে তাকে অপহরণ করে প্রথমে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এরপর দাবি করা মুক্তিপণের একটি অংশ পেলেও তথ্য পাচার করছে এমন সন্দেহ থেকে তাকে হত্যা করা হয়।

কী কী অপরাধ ঘটছে: গত এক বছর উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, মাদক কারবার, অপহরণ, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত এমন ২৩২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই সময়ে মোট মামলা হয়েছে ৯৭টি।

জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ৩৪টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় লোকজনকে টার্গেট করে মুক্তিপণ আদায় করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। বিভিন্ন নামে সেখানে অপহরণকারী বাহিনীও আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আবদুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম, জাকির বাহিনী, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন বাহিনী। স্থানীয় লোকজন ও রোহিঙ্গাদের কাছে তারা ডাকাত হিসেবেও পরিচিত।

চলতি বছরের জুলাইয়ে টেকনাফে অপহৃত হন সিএনজি অটোরিকশা চালক মাহমুদুল করিম। বাড়ি ফেরার পথে তাকে জঙ্গলে নিয়ে যান অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ হিসেবে অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর অপহরণকারীরা যে নম্বর থেকে ফোন করেছিলেন তা বন্ধ পাওয়া যায়। অপহরণের এক মাস পর গত আগস্টে বন বিভাগের লোকজন জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে একটি কঙ্কাল পান। কঙ্কালের পরণের পোশাক দেখে মাহমুদুল করিমকে শনাক্ত করেন তার পরিবারের সদস্যরা।

অভিযোগ আছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি বা আরসা নামের একটি সংগঠনের পরিচয়ে অনেকে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে আরসা নামধারীরা এখন অনেকটা কোণঠাসা। এই সংগঠনটিকে আল-ইয়াকিন নামে আরেকটি গ্রুপ সমর্থন দিয়ে আসছে। এটাও প্রচলিত আরসা ও আল-ইয়াকিন মুদ্রার ‘এপিঠ-ওপিঠ’। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ঘোর বিরোধী আরসাকে সন্দেহের চোখে দেখেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

১৪ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, এপিবিএনের তৎপরতা, স্থানীয় রোহিঙ্গা ও স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে পাহারা জোরদার করার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ আগের চেয়ে নিরাপদ। যারা অপরাধে জড়িত ছিলেন তারা এরই মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছেন। সৈয়দ আমিনকে হত্যার ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ক্যাম্পে কোনো আরসা নেই। তবে আরসার পরিচয় অনেকে ব্যবহার করতে চান।

সূত্র : নতুন সময়
এন এইচ, ১৯ ডিসেম্বর

Back to top button