লালমনিরহাট, ৩১ অক্টোবর- লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় হত্যাকাণ্ডের শিকার মো. শহিদুন্নবী জুয়েল (৫০) এর বাম গালে প্রথমে দুইটি থাপ্পড় মারার কথা স্বীকার করেছেন স্থানীয় আবুল হোসেন (৩৮)। মসজিদের ভেরত থাপ্পড় মারার পর সেখান থেকে তাকে বের করে আনা হয় বলে শুক্রবার (৩০) রাতে জানিয়েছেন আবুল হোসেন। পরে সেখান থেকে জুয়েলকে উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পর লাশ সড়কে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।
আবুল হোসেন বুড়িমারী ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর এলাকার হাবু মিয়ার ছেলে। তিনি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের পূর্ব-দক্ষিণে রুমেল মার্কেটের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী। বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের একজন নিয়মিত মুসল্লি তিনি।
আবুল হোসেন বলেন, ‘আসরের নামাজ শেষে মসজিদের আঙিনায় বুড়িমারীর বড় রেজোয়ানের (রেজোয়ান বুড়িমারী বাজার সমিতির সভাপতি ও ওই মসজিদ কমিটির সম্পাদক) ছেলে রিয়াদ (৩৩), তার দুই ম্যানেজার, অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ও আমি উপস্থিত ছিলাম। এ সময় রিয়াদের সঙ্গে জমির পাওনা টাকার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ মসজিদের ভেতরে খাদেম জুবেদ আলীর সঙ্গে জুয়েলের বাকবিতণ্ডার শব্দ শুনে আমি এগিয়ে যাই। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে খাদেমকে গালিগালাজ করছিলেন নিহত জুয়েল। আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি র্যাবের লোক বলে দাবি করেন। একেক সময় একেক পরিচয় দেওয়ায় আমার সন্দেহ হয়। এ সময় আমি প্রচণ্ড রাগের মাথায় তার বাম গালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে মসজিদের বাইরে নিয়ে এসে বারান্দার সিঁড়িতে বসিয়ে নাম-ঠিকানা জানতে চাই। তার সঙ্গে থাকা অপর ব্যক্তি আমাদের জানান, তারা রংপুর থেকে এসেছেন। একজন-দুইজন করে প্রায় ২৫-৩০ জন মানুষ জড়ো হয়। আমি প্রথমে চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাতকে ফোন করি। তিনি বাইরে থাকার কথা জানিয়ে ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলামকে ডাকতে বলেন। এরপর হাফিজুল ইসলামকে ফোন করে ডেকে আনি এবং ওই দুই ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল, খাতা-কলম ও দুইটি জ্যাকেটসহ তার হাতে তুলে দিই। এরপর আমি ভাবতে পারিনি পরিস্থিতি এমন হবে। আমি নিজেও এমন ঘটনা পছন্দ করি না।’
গুজব ছড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল হোসেন বলেন, ‘মেম্বারের হাতে তাদের তুলে দেওয়ার পরই মসজিদ কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রধান আসেন। পরে তিনিও ইউনিয়ন পরিষদে যান। কিন্তু কীভাবে কথাগুলো ছড়িয়ে পড়লো এবং মানুষ জড়ো হলো তা আমি বলতে পারি না। মেম্বারের হাতে ওই দুই ব্যক্তিকে তুলে দেওয়ার পর আমি আর ওদিকে যাইনি।’
আপনি মারধর না করলে হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না, এমন বক্তব্যের বিষয়ে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রধানের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলে তাকে সরাসরি বা ফোনে পাওয়া যায়নি।
বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ব্যবসায়ী গোলাম রব্বানী বলেন, ‘হঠাৎ বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদ চত্বর এলাকায় লোকসমাগম ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখলাম চারদিক থেকে লোকজন ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে জানালা-দরজা ভেঙে প্রবেশ করছে। মুহূর্তেই হাজার হাজার লোক জড়ো হয়। পরে শুনলাম, কোরআন অবমাননা করার কারণে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আমি ওদিকে যেহেতু যাইনি, সেহেতু বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন পরিষদের আসবাবপত্র, গ্রিল, দরজা-জানালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনা তদন্তে এবং প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি।’
লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এজন্য কিছুটা সময় নিয়ে মামলা রুজু করা হবে। জড়িতদের গ্রেফতারে মাঠে নেমেছি।’
আরও পড়ুন: কোরআন অবমাননার ঘটনাটি ‘গুজব’
এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। এর পর মামলা করা হবে। এসব বিষয়ে পুলিশ ও সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে। সব বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) রাতে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা শহীদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তার শরীর আগুনে পুড়িয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন
আডি/ ৩১ অক্টোবর