নরসিংদী

আজ নরসিংদী মুক্ত দিবস

নরসিংদী, ১২ ডিসেম্বর – আজ ১২ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে সম্মিলিত মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে নরসিংদী শহরসহ গোটা জেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। প্রতি বছরই দিবসটি উপলক্ষ্যে নরসিংদীতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন ১১৬ জন। এর মধ্যে নরসিংদী সদরে ২৭, মনোহরদীর ১২, পলাশে ১১, শিবপুরের ১৩, রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলার ১৬ জন শহীদ হন।

নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এক অদম্য শক্তি নিয়ে, স্বপ্রণোদিতভাবে। যুদ্ধ অনভিজ্ঞ তরুণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা প্রতিশোধ স্পৃহায় অটুট মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মনোবলই যে অধিকতর শক্তিশালী পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তার প্রমাণ রেখেছেন নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধারা।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার স্বাক্ষী অনেক গণকবর রয়েছে নরসিংদী জেলাজুড়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনও অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে এসব গণকবর। সংরক্ষণ না করায় অরক্ষতি এসব গণকবরের শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরসিংদীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে ৭১-এ পাক সেনাদের নিষ্ঠুর ছোবল পড়েনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদী জেলায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ৭১’এ বর্তমান জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৭/২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটক রাখা হতো। নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন লোহাপুলের নীচে। সেখানে ৪/৫ জনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২০/২২ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা শেষে লোহারপুলের নীচে সবাইকে একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হত।

৭১’এর মার্চে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে শত শত যুবকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। পরে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে চোরাগুপ্তা হামলা।

৪ এপ্রিল পাকবাহিনীর বোমারু বিমান নরসিংদী শহরে বোমাবর্ষণ শুরু করে। তখন গোটা শহরে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পাকবিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে শহীদ হন আব্দুল হক ও নারায়ন চন্দ্র সাহাসহ নাম না জানা আরো ৮ জন।

২৩ মে তৎকালীন মুসলীম লীগ নেতা মিয়া আব্দুল মজিদ মুক্তি সেনাদের গুলিতে নিহত হন। এর পরেই পাক বাহিনী নরসিংদী টেলিফোন ভবনে ঘাঁটি স্থাপন করে। স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সাহায্যে হানাদার বাহিনীরা প্রতিদিন চালায় ধর্ষণ, নরহত্যা ও লুটতরাজ।

মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী মুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী জেলা ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। পরে নরসিংদীকে ৩ নম্বর সেক্টরে নেওয়া হলে কামান্ডারের দায়িত্ব পান মো. নুরুজ্জামান।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য জাতীয় পর্যায়ে খেতাব ভূষিত হয়েছেন নরসিংদীর ৬ জন। তারা হলেন বীর শ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান, বীর প্রতিক নেভাল সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, বীর বিক্রম লে. কর্ণেল আব্দুর রউফ, বীর বিক্রম সুবেদার খন্দকার মতিউর রহমন, বীর বিক্রম বিগ্রেডিয়ার (অব.) এ.এস.এম নুরুজ্জামান ও বীর বিক্রম লে. কর্ণেল (অব.) নুরুল ইসলাম ভূইয়া।

এ জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সমুন্নত রাখতে স্বাধীনতার ৩৪ বছর পর ২০০৫ সালে নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক নির্মিত হয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নরসিংদীর নতুন প্রজন্মের দাবি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণকবরগুলো সংরক্ষণ করে স্মৃতি ফলক নির্মাণ করে স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরা।

সূত্র : রাইজিংবিডি
এন এইচ, ১২ ডিসেম্বর

Back to top button