জাতীয়

আবরার হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক নৃশংসতার করুণ পরিণতি

ঢাকা, ০৯ ডিসেম্বর – বুধবার সময় তখন দুপুর ১২টা। ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পিনপতন নীরবতা। কাঠগড়ায় ২২ আসামি। সামনে আইনজীবী, বাদী-বিবাদীর স্বজন ও গণমাধ্যমকর্মী। সবার চোখ বিচারকের এজলাসের দিকে। বহুলপ্রতীক্ষিত রায় পড়া শুরু করেছেন বিচারক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়।

বিচারক বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামিদের সবার সংশ্নিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই নৃশংস ঘটনা দেশের সকল মানুষকে ব্যথিত করেছে। এমন মেধাবী ছাত্রের নৃশংস হত্যাকাে র মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভবিষ্যতে যেন আর কখনও না ঘটে তা প্রতিরোধে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেওয়া হলো।’

২০ মিনিট সময় নিয়ে পড়া রায়ে আদালত ২০ আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়ে এজলাস ছাড়েন বিচারক।

ততক্ষণে সেখানে নীরবতা ভেঙেছে। বাদীপক্ষ রায়ে সন্তুষ্টির কথা জানালেও আসামিপক্ষ নিজেদের অসন্তুষ্টির কথা জানায়। কেউ মোবাইল ফোনে স্বজনদের জানাচ্ছিলেন রায়ের কথা। তবে কাঠগড়ায় আসামিরা ছিলেন অনেকটাই নীরব। এসবের মাঝে কেউ কেউ আফসোস করে বলছিলেন, ‘সহপাঠীর প্রতি নৃশংসতায় ভয়ংকর পরিণতি হলো তাদেরও। আবরারের পরিবারের সঙ্গে ধ্বংস হলো আরও ২৫টি পরিবার।’

আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন শেরেবাংলা হলে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে সরকারের সমালোচনা করে নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেছিলেন তিনি। এতে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ ক্ষিপ্ত হয়। এর জেরে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে তাকে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আসামিরা আবরারের নিথর দেহ হলের সিঁড়িঘরে ফেলে রেখে যান। ওই ঘটনায় দায়ের মামলায় গতকাল আদালত ২৫ আসামির বিরুদ্ধে রায় দিলেন। ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান রায় পড়েন। এ সময় ২২ আসামি কাঠগড়ায় ছিলেন।

মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ২০ জন :বুয়েট ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, ছাত্রলীগ কর্মী মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর, মো. শাদাত ওরফে এসএম নাজমুস সাদাত, মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামছুল আরেফিন রাফাত, মো. শামীম বিল্লাহ, মাজেদুর রহমান মাজেদ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মনিরুজ্জামান মনির, মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, মোজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, অনিক সরকার অপু, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ইফতি মোশাররফ সকাল, এসএম মাহামুদ সেতু, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম ল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ। তাদের মধ্যে জিসান, তানিম ও রাফিদ পলাতক।
বিচারক ২০ জনকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দেন। পাশাপাশি পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে বলেন। যে তারিখে তারা ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করবে বা পুলিশ গ্রেপ্তার করবে, সেই তারিখ থেকে তাদের দণ্ড কার্যকর হবে।

যাবজ্জীবন পাওয়া পাঁচজন :বুয়েট ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, ছাত্রলীগ কর্মী মো. মোয়জ ওরফে মোয়াজ আবু হোরায়রা, আকাশ হোসেন, ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না ও অমিত সাহা। পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছর সাজা ভোগ করতে হবে তাদের।

রায়ের পর্যবেক্ষণ :পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলের ক্যান্টিনে এবং পরদিন রাত ১০টার পর আসামিরা দফায় দফায় মিটিং করেন। তারা ৬ অক্টোবর রাত ৮টা থেকে ৭ অক্টোবর ভোর পর্যন্ত শেরেবাংলার আবাসিক হলের ২০১১ ও ২০০৫ নম্বর রুমে আবরার ফাহাদকে চড়-থাপ্পড়, লাথি, কিল, ঘুষি মেরে, কনুই দিয়ে পিঠে, ক্রিকেট স্টাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত?্যা করা হয়।’

প্রতিক্রিয়া :রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশবাসী একটি কলঙ্ক থেকে আইনের মাধ্যমে বিচারের মাধ্যমে মুক্ত হতে পেরেছে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কোথাও যেন উত্তেজিত হয়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। আবরারের মতো নিরীহ মেধাবী কোনো শিক্ষার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর যেন এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা না যান, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকাতে হবে।

কাজল আরও বলেন, আদালত বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের র‌্যাগিং বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসবে বড় ভাইরা মমতা দিয়ে পথ প্রদর্শন করবেন। কিন্তু র‌্যাগিং বন্ধ করা উচিত।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহমেদের ভাষ্য, আসামিরা ন্যায়বিচার পাননি। মূল হোতা ও বড় ভাইদের নাম রায়ে আসেনি। বড় ভাই কারা ছিল, তাদের নাম তদন্তে আনা হয়নি। বুয়েট কর্তৃপক্ষের যে নিরাপত্তার বিষয়ে অবহেলা ছিল, তাদেরও রায়ে আনা হয়নি।
রায়ের কপি পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানান ফারুক আহমেদ।

আদালতের দৃশ্য :রায় ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে থাকা ২২ আসামিকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের তৃতীয় তলায় এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কক্ষে স্থাপিত কাঠগড়ায় একে একে ২২ আসামিকে হাতকড়া পরা অবস্থায় হাজির করা হয়। ১১টা ৫৮ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপর রায় পড়া শুরু হয়। ১২টা ১০ মিনিটে আদালত আসামিদের দে র আদেশ ঘোষণা করেন।

এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিরা নীরব ছিলেন। কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাননি তারা। আসামিদের পরিবারের সদস্যদের অনেককে এজলাসে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। রায়ের পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন আসামির চোখ ভিজে গেছে। পরে তাদের আবার মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সোয়া ১টার দিকে তাদের প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। এ সময় আসামিদের মধ্যে কয়েকজন কাঁদতে থাকেন। কেউ আবার স্বজনদের সান্ত্বনা দেন। স্বজনরাও আসামিদের ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দেন।

প্রেক্ষাপট :আবরার হত্যার পরদিন ৭ অক্টোবর রাজধানীর চকবাজার থানায় তার বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার এক মাস ছয় দিন পর ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন।

২৫ আসামির মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ১৯ জন। গত বছর ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আদালত। মোট আসামির ২৬ জনের মধ্যে ২২ আসামিকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৬০ সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ২১টি আলামত ও আটটি জব্দ তালিকা আদালতে জমা দেওয়া হয়। আট আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলার অভিযোগপত্রে কিছু ত্রুটি থাকায় রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি পুনরায় চার্জ গঠনের আবেদন করে। পরদিন ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় চার্জ গঠন করেন আদালত। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২৮ নভেম্বর রায়ের জন্য দিন রাখেন আদালত। কিন্তু রায় প্রস্তুত না হওয়ায় সেদিন রায় ঘোষণা পিছিয়ে ৮ ডিসেম্বর রাখা হয়েছিল।

সূত্র : নতুন সময়
এম এস, ০৯ ডিসেম্বর

Back to top button