ঢাকা, ৩০ নভেম্বর – সোলারে পুড়ল সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকলের (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড) ১৫শ কোটি টাকা। মানহীন ও নামসর্বস্ব সোলার প্যানেল বসিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কতিপয় অসাধু পার্টনার (এনজিও) এই বিশাল অঙ্কের অর্থ লোপাট করেছে। এ ধরনের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
গ্রাহকদের অভিযোগ, ইডকলের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এনজিওগুলো বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাড়ি-ঘর, হাটবাজারে মানহীন, কম দামি সোলার প্যানেল বসিয়েছিল। নিুমানের কারণে ৫-৬ মাসের মাথায় বেশির ভাগ প্যানেল নষ্ট হয়ে যায়। সংস্কার করেও তা সচল রাখা সম্ভব হয়নি। এ কারণে গ্রাহকরা কিস্তি বন্ধ করে দেয়। কোনো কোনো গ্রাহক ক্ষোভে-দুঃখে বাড়ির ছাদ থেকে প্যানেল ভেঙে নামিয়ে ফেলে। এতে মাঠ পর্যায়ে ১৫০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ খেলাপি হয়ে পড়ে।
ইডকল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছে, শর্ত লঙ্ঘন করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সমিতিগুলো তাদের সোলার গ্রাহকদের আঙিনায় অবৈধভাবে গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে। ফলে গ্রাহকরা আর সোলারের কিস্তি দিচ্ছে না। উলটো এনজিওকর্মীরা কিস্তির টাকা চাইতে গেলে মারধরের শিকার হচ্ছেন। এ কারণে এই টাকা খেলাপি হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে তৎকালীন ইডকলের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহমুদ মালিক এর আগে বলেন, আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বিভিন্ন কারণে মানুষ সৌরবিদ্যুতের সংযোগ নিতে চাচ্ছেন না। আগের কিস্তিও ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না অনেকে। বিশেষ করে এই ১৫০০ কোটি টাকা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। এই টাকা আদায় ইডকলের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। তাই টাকাগুলো আগে থেকেই অবলোপনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইডকলের অন্যতম বড় পার্টনার হিলফুল ফুজুল ঋণ নিয়ে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন প্রকল্পে ১৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ঘটনায় হিলফুল ফুজুল সমাজকল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলামসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এই সংস্থাটি ইডকলের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে পুরো টাকা লোপাট করেছে। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এনজিওটি কাগজে-কলমে ঝালকাঠি, নলছিটিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বাড়ি-ঘর ও মহল্লার দোকানে সোলার প্যানেল বসানোর কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু ঠিকানায় গিয়ে কোনো বাড়ি-ঘর কিংবা কোনো স্থাপনারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
দুদকের মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইডকল হিলফুল ফুজুলকে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১৫৬টি সোলার হোম সিস্টেমের বিপরীতে ১৩৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ঋণ দেয়। এর মধ্যে প্রথমদিকে কিছু টাকা পরিশোধ করলেও পরে কিস্তির টাকা পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে ১০৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। যা সুদসহ মোট ১৪৯ কোটি ১৭ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। শুধু হিলফুল ফুজুল নয়, ম্যাকস রিনিউয়েবলসহ আরও অসংখ্য ইডকল পার্টনারের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে হিলফুল ফুজুল সমাজকল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
সূত্র জানায়, ত্রিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব ও সমঝোতার আওতায় ইডকলের এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছিল। এক্ষেত্রে কোনো গ্রাহক সোলার হোম সিস্টেম বসাতে চাইলে ইডকল ঋণ কর্মসূচির আওতায় ৭০ ভাগ খরচ বহন করে। বাকি ৩০ ভাগ খরচ দিত ইডকলের পার্টনার অর্গানাইজেশন (পিও) এবং গ্রাহক। সোলার হোম সিস্টেম চালু হওয়ার পর গ্রাহক মাসিক কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করত। পিও সেগুলো ইডকলের কাছে ফেরত দিত। এ প্রক্রিয়ায় কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন হচ্ছিল। এভাবেই এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৫৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম বসানো হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ৫৫ লাখের অর্ধেক সোলার প্যানেলও এখন নেই। বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা গ্রাহকরা সেগুলো ভেঙে ফেলেছে। এ অবস্থায় এই খাতের প্রায় ১৫শ কোটি টাকা অবলোপন করতে দৌড়ঝাঁপ করছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকল।
চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার ১৬ হাজার সোলার প্যানেলের অর্ধেকই নষ্ট, প্রকল্পের নামে লোপাট কোটি টাকা : চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় গত তিন বছরে (২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত) ১৬ হাজার সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেল বসানো হয়। উপজেলার মসজিদ, মন্দির, স্কুল এবং সড়কের পাশে বা সামনে এসব সোলার বসে। তিন বছরে লাগানো সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেলের অর্ধেকই এখন অকেজো বা নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো সচল সেগুলোতেও আছে নানা ত্রুটি। কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) এবং গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় এসব সোলার সিস্টেম বসানো হয়। চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাইন্যেপাড়া গ্রামের চয়ন্তি সংঘ দুর্গা মন্দিরে ২০১৮ সালে সোলার প্যানেল লাগানো হয়। বছরখানেক প্যানেলটি আলো দেওয়ার পর এখন নষ্ট। মন্দির কমিটির সভাপতি কমল কর বলেন, ‘মন্দিরের ভেতর সৌরবিদ্যুতের সোলার সিস্টেমটি বেশ কিছুদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
লাগানোর পর কেউ তদারকির জন্য আসেনি। বোয়ালখালী উপজেলার আমুছিয়া ইউনিয়নের ধোরলা কালিবাড়ি, পূর্ব ধোরলা জামে মসজিদ, কানুনগোপাড়া মুক্তকৃষি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ধোরলা খাঁ বাহাদুর জামে মসজিদে দুই বছর আগে সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেল লাগানো হয়। বছরখানেক সচল থাকলেও সেগুলো এখন আর চলছে না। আমুছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজল দে বলেন, ‘এসব স্থানে সৌরবিদ্যুতের সোলার সিস্টেমগুলো লাগানোর পর দেখভালের জন্য কেউ আসেনি। যার কারণে কিছুদিন সচল থাকলেও এখন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। একই অবস্থা চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজেলায়ও।
সূত্র : যুগান্তর
এন এইচ, ৩০ নভেম্বর