‘উন্নত দেশেও খাদ্যের জন্য হাহাকার, যেটা আমাদের নেই’
ঢাকা, ১৭ নভেম্বর – অনেক উন্নত দেশে খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘লন্ডনে সুপারমার্কেটে সাপ্লাই নেই। খাবার জিনিস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশের কোনো খাদ্যের হাহাকার নেই।’
বুধবার (১৭ নভেম্বর) বিকেল ৪টায় সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণের প্রতি যে দায়িত্ববোধ, তা নিয়ে আমরা সবসময় সচেতন। করোনাকালে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত কৃষক থেকে শুরু করে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই যাদের আমরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করিনি। করোনার সময় ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছি। সুদের হার কমিয়ে অর্ধেক সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক থাকে। শ্রমিকরা যাতে বেতন পায় তার ব্যবস্থা করেছি।’
দলীয় প্রতীক দেওয়ার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত হচ্ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোথাও কোথাও সংঘাত হচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ শুধু চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দিয়েছে। নির্বাচন মেম্বার পদেও হচ্ছে। তাদের মধ্যেও মারামারি হচ্ছে। তাছাড়া অন্যান্য দলও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও তাদের প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। সুতরাং দলীয় প্রতীক দেওয়ার কারণে সংঘাত হচ্ছে- কথাটি ঠিক নয়।
তিনি বলেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেউ কোনোভাবে সংঘাতে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
দেশে অনেকে ট্যাক্সের টাকা ফাঁকি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘সবাই টাকা উপার্জন করে ট্যাক্স কতজন দেয়? সাংবাদিকদের প্রতি এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের চাল, ডাল, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। তারপরও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার দিকে নজর এবং এটাই বাস্তবতা। সরকারের টাকা আসবে কোথায় থেকে। এখন বিদ্যুৎ সবার ঘরে ঘরে। এখানেও ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলতে পারছি না।’
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। উৎপাদন বাড়ানোর সব ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। আমাদের তেল কিনে আনতে হয়।’
উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন কত টাকা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয়। পরে তিনি নিজেই উত্তর দেন।
তিনি বলেন, ‘২৩ হাজার কোটি টাকা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয়। বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকি। কৃষকদের জন্য সারের দাম আমারা কমিয়েছি। যে সার ৯০ টাকা ছিল তা কমিয়ে ১৫-১৬ টাকা করেছি। কৃষিতে প্রতিটি ক্ষেতে সহায়তা দিয়েছি। কার্ড করে দিয়েছি। এখন কৃষক ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। যার মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা সরাসরি তাদের কাছে যায়।’
জিয়াউর রহমানের সামরিক আদালতের প্রসঙ্গ নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সামরিক আদালত সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত ছিলেন। ওই সময়ে (১৯৭৫ সালের পর) একটা ক্যু হয়েছিল। প্রতিটি ক্যুতে সেনাবাহিনীর হাজার হাজার অফিসার, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত ছিল। তার নির্দেশে প্রহসনের বিচারের জন্য সামরিক আদালত বসানো হয়েছিল। কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন তার প্রকৃত সংখ্যা বের করা যায়নি।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ভোররাতে বিমানবাহিনীতে সংঘটিত বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। তখন সামরিক আদালতে ফাঁসি দেওয়া হয় ১১ জন অফিসারসহ এক হাজার ৪৫০ জন বিমান সেনাকে। বরখাস্ত ও চাকরিচ্যুত হন আরও চার হাজার জন। নিখোঁজ হন অসংখ্য।
সামরিক আদালতে নিহত পরিবারের সদস্যরা সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সময় আমার ফুফাতো ভাই ফিরোজ কবির চৌধুরী, যিনি ক্যামেরাম্যান ছিলেন, তাকেও হত্যা করা হয়। ওই সময় তাদের হত্যা করে বিলের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। জেলখানায় যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদের হয়ত খোঁজ পাবো। কিন্তু কত জনকে যে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছে, জানি না। তবে আমরা তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিবো। স্বজনদের হারিয়ে অসহায়দের অবস্থা আমি জানি। আমিও তো আপনজন হারিয়েছি।’
এসময় শেখ হাসিনা জানান, ওই সময়ে নিহত অনেকের পরিবারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলের এত বছর পর সেই সামরিক আদালত নিয়ে সরব হয়েছেন নাগরিক ব্যক্তিত্বরা।
তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ব্যাপারটা তো এত দিন কেউ তুলে ধরেনি। তবুও ধন্যবাদ, এত দিন পরে কথা হচ্ছে।’
বিশ্ব নেতাদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্মেলনে প্রধান কার্বন নির্গমণকারী দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য আনুপাতিক হারে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে একযোগে কাজ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার কথা বলেছি।
সরকার প্রধান বলেন, বিশ্বের সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের দাবি-দাওয়া তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছি। সিভিএফ’র সভাপতি হিসেবে একটি ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি প্যাক্ট গঠনের প্রয়াসের কথাও তুলে ধরি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে আলোচনায় দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিধি ও গভীরতা আরও বাড়বে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এ ছাড়া বাণিজ্য নীতি, রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
এই বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রশংসা করে জলবায়ু অভিযোজনে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য রুশনারা আলী ও লর্ড নিতেশ গারিয়ার আমন্ত্রণে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ অ্যাট ৫০, আ রেসিলিয়েন্ট ডেলটা’ শীর্ষক একটি কি-নোট উপস্থাপন করেন বলে জানান।
লন্ডনের প্রকাশনা সংস্থা টেইলর এড ফ্রান্সিস কর্তৃক ইংরেজিতে অনুদিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং ‘মুজিব অ্যান ইনট্রোডাকশন’ বই দুটির মোড়ক উম্মোচন করেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
এরপর প্রধানমন্ত্রী ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপের প্রসঙ্গে বলেন। প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতিসহ অন্যান্য খাতে দুই দেশের কার্যক্রম বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে তাদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
ইউনেস্কো সদর দফতরে সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানেও যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি মুজিববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের প্রেক্ষিতে এই পুরস্কার প্রবর্তন সবচেয়ে উপযুক্ত সম্মান। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।’
এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের বন্দরনগরী গ্লাসগো, যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন এবং ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সরকারি সফর করেন। দুই সপ্তাহের এই সফরে ৩১ অক্টোবর গ্লাসগো পৌঁছান তিনি।
সেখানে ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের (কপ২৬) উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মূল অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এ ছাড়া সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন এবং স্কটল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশিদের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।
সফরকালে ৩ নভেম্বর গ্লাসগো থেকে লন্ডন পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখানে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটি রোড শো উদ্বোধন করেন এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। এছাড়া লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নাগরিক সংবর্ধনাসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।
৯ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখানে এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোনের সঙ্গে এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সরকারি বাসভবনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কো সদর দপ্তরে ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, ইউনেস্কোর ৪১তম সাধারণ সম্মেলন, প্যারিস শান্তি ফোরাম, ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও যোগ দেন। ১৩ নভেম্বর ফ্রান্স থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে ১৪ নভেম্বর সকালে ঢাকায় পৌঁছান শেখ হাসিনা।
সূত্র: রাইজিংবিডি
এম ইউ/১৭ নভেম্বর ২০২১