জাতীয়

তৃণমূলে কমিটি গঠনে অভিযোগের স্তুপ বিএনপির দপ্তরে

ঢাকা, ০৪ নভেম্বর – বিএনপির তৃণমূলে কমিটি গঠনে নানা অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ছে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। এতে দলটির বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠন বিশেষত যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের থানা, পৌর কমিটি গঠনে ত্যাগী ও যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের মূল্যায়ন করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

অনেক ক্ষেত্রে এসব জায়গায় ‘এক নেতার এক পদ অনুসরণ না করে’ নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নেতা বানানো হচ্ছে বলে তারা লিখিত অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছেও প্রমাণ সহকারে উপস্থাপন করছেন বলে দলটির একাধিক সূত্র জানা গেছে।

সূত্র জানায়, প্রত্যেকটি অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। এর মধ্যে বিএনপির অন্যতম অঙ্গ সংগঠন যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে গঠিত ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি। একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা বিভাগীয় টিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ। এর বাইরে যুবদলের বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগীয় টিম এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের বরিশাল বিভাগীয় টিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুবদলের তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে ১১টি টিম গঠন করা হয়। ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, থানা ও পৌর প্রতিটি ইউনিটে আহ্বায়ক কমিটি করতে প্রত্যেক টিমকে নির্দেশ দেয়া হয়। টিমের কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে সরেজমিনে গিয়ে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও পৌর কমিটির সাংগঠনিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন প্রস্তুতির আগে সংশ্লিষ্ট জেলা ও মহানগর নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি গঠনে যারা জনপ্রিয়, সাহসী ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে থাকবে-এমন নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করতে বলা হয়। অযোগ্যদের দিয়ে কমিটি সংখ্যায় বড় না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রতিটি টিমকে।

এদিকে দলের এসব নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করে অধিকাংশ সাংগঠনিক টিমের নেতারা বিভিন্ন অনিয়মে যেমন জড়িয়ে পড়েছেন তেমনি কমিটি গঠনে ত্যাগীদের বাদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। তাদের এসব অনিয়ম বাস্তবায়ন করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নামকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও নেতাকর্মীরা জানান। তারেক রহমানের সাথে তৃণমূল নেতাকর্মীদের এমনকি অনেক সময়ে স্থানীয় বিএনপির নেতারা যোগাযোগ করতে পারেন না বলে এ সুযোগে তাকে সামনে আনা হয়।

যুবদলের সাংগঠনিক টিমের মধ্যে সবচেয়ে অভিযোগ রয়েছে ঢাকা বিভাগীয় টিমের বিরুদ্ধে। অভিযোগকারীরা এই টিমের বিরুদ্ধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অনাস্থা জানিয়েছেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেসব অভিযোগকে আমলে নিয়ে কোনো তদন্ত করা হয়নি, কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।

এরকম একটি অভিযোগ জমা পড়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতামতকে উপেক্ষা করে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর শ্রীপুর থানা যুবদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে আহ্বায়ক করা হয়েছে আতাউর রহমান মোল্লাকে। যিনি গাজীপুর জেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক। গুরুত্বপূর্ণ এমন পদে থাকার পরও তাকে থানা যুবদলের আহ্বায়ক করায় বিস্মিত নেতাকর্মীরা।

এখানে একদিকে যেমন এক নেতার এক পদ নীতি যেমন অবলম্বন করা হয়নি, তেমনি দীর্ঘদিন ধরে যারা থানা যুবদলে সক্রিয় ছিলেন তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার আতাউর রহমান মোল্লা সপরিবারে ঢাকায় বসবাস করেন। বিগত দিনে শ্রীপুর থানা বিএনপির কোনো কার্যক্রমে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না।

ঘোষিত কমিটির মাইদুল ইসলাম সজিবকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। যিনি এর আগেও ইউনিয়ন কিংবা থানা ছাত্রদল বা যুবদলের কোনো দায়িত্ব পালন করেননি। এই কমিটিকে আবার গত ২১ অক্টোবর ৪৪ সদস্য বিশিষ্ট করা হয়। যাতে ত্যাগী, দক্ষ, যোগ্য ও অসংখ্য মামলার আসামি এবং কারা নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরও বাদ দেয়া হয়েছে।

একই টিমের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানা কমিটি গঠনেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আড়াইহাজার থানা যুবদল কমিটি গঠনে তারেক রহমানের নামকে ব্যবহার করেছে সাংগঠনিক টিম। আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্তদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছে বিএনপির দপ্তরে। এতে প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও সংযুক্ত করা হয়েছে।

অভিযোগে নেতাকর্মীরা জানান, ঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক অর্ধশিক্ষিত। ৫ বছর আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন। এলাকায়ও থাকেন না। সদস্য সচিব খোরশেদ মোল্লা কোনো দিন রাজনীতিই করেননি। এর আগে তার কোনো পদ-পদবীও ছিলো না। পৌর যুবদল সদস্য সচিব একযুগ ধরে সৌদি প্রবাসী।

বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। তাদের একচেটিয়া সিদ্ধান্তের কারণে ইতোমধ্যে ভোলা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ৫৬ জন নেতা পদত্যাগ করেছেন। জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আল আমীনকে ঠেকানোর জন্য তার বিরুদ্ধে কমিটি দেয়া হয়েছে। অথচ আল আমীনের মতো ত্যাগী ও যোগ্য নেতা যার বিরুদ্ধে প্রায় ৭০টি মামলা রয়েছে, তাকে কোণঠাসা করতেই এরকম কমিটি দেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানা কমিটি গঠনেও তুঘলকি কাণ্ড করছে একই সিন্ডিকেট। জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জনি ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান মামুন যোগসাজশ করে অযোগ্যদের দিয়ে কমিটি করতে চাইছেন। এর সাথে সংগঠনের একজন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতাও জড়িত বলে সূত্র জানায়। তাদের এমন তৎপরতার কারণে এখন পর্যন্ত এ থানা কমিটি গঠন সম্ভব হচ্ছে না।

সারাদেশে কমিটি গঠনে ঢাকা বিভাগীয় টিম ছাড়াও ময়মনসিংহ বিভাগীয় টিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ।

মুক্তাগাছা থানা যুবদল কমিটি গঠনে নিষ্ক্রিয় আর অযোগ্যদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সক্রিয়দের বিরুদ্ধে তারেক রহমানের কাছে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। যদিও পরবর্তিতে কেন্দ্রীয় যুবদলের হস্তক্ষেপে যোগ্যদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন সম্ভব হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধেও।

এবিষয়ে কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে কমিটির প্রসঙ্গ শুনেই তিনি বলেন, আমি এখন মিটিংয়ে আছি। আপনার সঙ্গে পরে কথা বলবো।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা একটা বড় সংগঠন। যিনি পদ পান, তিনি কিছু বলেন না। যিনি পদ পান না, তিনি অভিযোগ করেন।

কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা কমন কথা। এর কোনো ভিত্তি নেই।

সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এম ইউ/০৪ নভেম্বর ২০২১

Back to top button