গোঁফ বা মোচ হল উপরের ওষ্ঠের উপরে গজানো চুল। রকমফেরে গোঁফ কত রকমের হতে পারে ? অনেকেই এর উত্তরে হয়তো নানান ধরণের গোঁফের কথা বলবেন যেমন-সরু গোঁফ , মোটা গোঁফ , খ্যাংড়া কাঠির মত গোঁফ, হিটলারের গোঁফ, স্ট্যালিনের গোঁফ। এগুলো সাধারণ মানুষের ভাষা। কিন্তু এর বাইরেও আছে বাহারি নামের ও ডিজাইনের গোঁফ।
সাধারণত কারও গোঁফ আছে বলা হলে মনে করা হয় তার ওষ্ঠের ওপরের অংশটুকুতেই তা সীমাবদ্ধ আছে। বয়সন্ধিকালে ছেলেদের গোঁফ ওঠার শুরু হয়। নিওলিথিক যুগ থেকেই পাথরের ক্ষুর দিয়ে ক্ষৌরি করার চল শুরু হয়, আর এই সুদীর্ঘকালের ব্যবধানে গোঁফের নানান রকম ফ্যাশন চালু হয়েছে। যারা গোঁফ রাখে তারা নিয়মিত ছেঁটে ও আঁচড়ে রীতিমত এর যত্ন করে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ ও সযত্নে রক্ষিত গোঁফের প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে। বিশ্ব দাড়ি ও গোঁফ চ্যাম্পিয়নশিপে ছ`টি উপবিভাগে গোঁফের বিভাজন করা হয়। গোঁফের এমন কদর দেখেই হয়ত বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ননসেন্স ছড়াকার সুকুমার রায় বলেছিলেন:
“গোঁফকে বলে তোমার আমার – গোঁফ কি কারো কেনা?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।
যুগ যুগ ধরে পুরুষদের কাছে গোঁফের কদর অপরিসীম। সাধারণত ছাঁটাই কিংবা নানান শৈলীর গোঁফ মক্ষিকারের সাহার্যে গোঁফের যত্ন নেয়া হয়ে থাকে। পৌরুষত্ব ও শৌর্য্যের প্রতীক হিসাবে গণ্য গোঁফ, সমাজে চিরকালই পুরুষদের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অনেক বিখ্যাত মানুষের সিগনেচার গোঁফ এমনই বিখ্যাত যে শুধু গোঁফটি আঁকলেই সবাই মানুষটির নাম বলে দিতে পারবেন। গোঁফের সম্বন্ধে আর কিছু বলার আগে চলুন গোঁফের ইতিহাসটা একটু নেড়ে চেড়ে দেখি। প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে মিশরে চতুর্থ রাজবংশের রাজপুত্র Rahotep-এর গোঁফ ছিল। চীনের ইতিহাসে সম্রাট Qin Shi Huang-র দাড়ি ও গোঁফ ছিল। সম্রাট কুবলা খানেরও দাড়ি ও গোঁফ ছিল।
এদিকে ভারতের গোঁফের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রাচীন ভারতবর্ষে দাড়ি ছাড়া শুধু গোঁফ সম্ভবত খুব বেশি জনপ্রিয় ছিল না। তবে বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ঋকবেদে আনুমানিক ১২০০ খৃঃপূঃ বর্ণিত রুদ্রের দাড়ি-গোঁফ এবং তার সাথে জটাও ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ঋকবেদের এই রুদ্রই পরবর্তী কালে শিব বা মহাদেবে রূপান্তরিত হন। এদিকে ইন্দ্রেরও দাড়ি-গোঁফ ছিল।
পৌরাণিক দেবতাদের গোঁফদাড়িহীন চির-কিশোর রূপে দেখানো হলেও মহাদেবের বৈরাগ্যমূর্তিতে দাড়ি-গোঁফ ছিল। দেবসেনাপতি কার্তিকেরও গোঁফ বা গোঁফদাড়ি ছিল। মহাকাব্যের নায়কদের মধ্যে রাম ও লক্ষ্মণের বনবাসে থাকাকালীন গোঁফ-দাড়ি ছিল। রাবণ, ইন্দ্রজিৎ এবং বিভীষণের গোঁফ ছিল বলে জানা যায়।
এতো গেল পৌরাণিক চরিত্রদের কথা। এবার আধুনিক যুগের গোঁফের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাজপুতদের মধ্যে গোঁফ খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং এখনও আছে। বর্তমানে দীর্ঘতম ১৪ ফিট গোঁফের মালিক রাম সিং চৌহান একজন রাজপুত। আবার অন্যান্য যোদ্ধা জাতের মধ্যেও গোঁফ পৌরুষত্বের প্রতীক হিসাবে গণ্য হত।
এখানে একটি বিচিত্র ব্যাপার না বললেই নয়। ইংরেজরা সাধারণতঃ দাড়ি-গোঁফ রাখতো না। কিন্তু তাদের এই clean shaven look তাদের এক বিপদে ফেলেছিল। ইংরেজরা যখন ভারতীয়দের সৈন্য হিসাবে নিতে শুরু করলো, তখন লম্বা ও জমকালো গোঁফওলা ভারতীয় সৈন্যরা দাড়িগোঁফ কামানো ইংরেজদের অবজ্ঞার চোখে দেখত এবং ইংরেজ অফিসারদের মানতে চাইত না। শুনলে হাসি পেলেও এই সমস্যাটি এমন গুরুতর আকার ধারণ করলো যে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রথমে ইংরেজ সৈন্যরা ও পরে অসামরিক ইংরেজরা গোঁফ বা দাড়ি-গোঁফ রাখতে শুরু করে, এমনকি একটি বিশেষ ধরণের গোঁফের নামই হয়ে যায় English moustache । ক্রমে এই গোঁফ ভারতীয় শিক্ষিত এবং ধনী সমাজেও খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাহলে আসুন জেনে নেই পৃথিবী বিখ্যাত গোফয়ালা মানুষদের নাম ও সেই সাথে তাদের আবিস্কৃত গোঁফের নাম যা পরবর্তীতে সাধারন মানুষেরা অনুকরন করেছিলেন।
আরও পড়ুন: এবার ফরাসী পণ্য বর্জনের ডাক দিলেন এরদোগান
বিদ্রুপাত্মক সহিত্য-রচয়িতা মাইকেল “আর্তেস” আতরে, ইনভারসিলের জেনারেল জর্জ ক্যাম্পবেল, এবং Venceslau Brás, সাবেক ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতির পাকানো বা সাম্রাজ্যিক গোঁফ ছিল। আবার এডলফ হিটলার ও চার্লি চ্যাপলিনের গোঁফের নাম টুথব্রাশ গোঁফ। অধিবাস্তববাদী সালভাদোর দালির গোঁফের নাম ঢেউখেলানো সরু গোঁফ, যা তিনি বেশ জনপ্রিয় করেছিলেন। আছে হাল্ক হোগানের অশ্বখুর গোঁফ। রিচার্ড পেটির গোঁফ শেভরনের গোঁফ নামে পরিচিত। জন ওয়াটার্সের এবং আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের ছিল পেন্সিল গোঁফ। প্রশস্ত “মেক্সিকান” গোঁফ রাখতেন এমিলিয়ানো জাপাতা। আবার ছিল ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের সিন্ধুঘোটক গোঁফ। আপনার যদি গোঁফ থেকে থাকে তাহলে বলুনতো আপনি কোন গোঁফ গোত্রের অধিকারী ?
আডি/ ২৮ অক্টোবর