ঢাকা, ১৬ অক্টোবর – ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিতর্কিতদের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। অর্থের বিনিময় বা নিজের বলয় ধরে রাখতে প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে তারা বিতর্কিতদের মনোনয়ন পাইয়ে দিচ্ছেন।
ফলে অনেক ক্ষেত্রে দলের যোগ্য প্রার্থী হচ্ছেন মনোনয়নবঞ্চিত। এতে ত্যাগীদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ ও হতাশা। বিভিন্ন স্থানে তাদের সমর্থকরা বিক্ষোভ করে জানাচ্ছেন প্রতিবাদ। প্রার্থী পরিবর্তন না হলে অনেকেই ভোটের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে বিদ্রোহী প্রার্থী বাড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া শতাধিক প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। গত এক সপ্তাহে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে এসব অভিযোগ জমা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে কেউ স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী পরিবারের সদস্য, সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িত।
কেউ আবার বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা, খুন ও নারী নির্যাতন মামলার আসামি। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, বিধবাভাতার কার্ড নিয়ে প্রতারণা, গরিবের চাল বিক্রিসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের নামও আছে এ তালিকায়।
টাকার বিনিময়ে এসব বিতর্কিতকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলেও অনেকে অভিযোগ তুলেছেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা।
ছয় দিনে প্রায় ৫০ ঘণ্টা বৈঠকে ৪৪৫৮ জন প্রার্থী থেকে ৮৪৮ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্লেন (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের সভায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করেই দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি-না, দলে তার অবদান কতটা, এলাকায় সে কতটা জনপ্রিয় তা দেখেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি ইউপিতে বেশ কয়েকজন করে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। কোনো কোনো ইউপিতে ৮-৯ জন করেও প্রার্থী ছিল। সেখান থেকে যে যোগ্য তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
মনোনয়ন পাওয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিদিন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় শুরুতে আগের দিন মনোনয়ন পাওয়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে কি-না তা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রার্থী পরিবর্তনও করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিতর্কিত ও বিদ্রোহীদের মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী লীগের। এ বিষয়ে তৃণমূলে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও কোথাও কোথাও নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি করেছেন স্থানীয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ উপজেলা পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা। কিছু কিছু জায়গায় পাঠানো হয়েছে একজনের নাম।
ডামি প্রার্থী করে একাধিক নাম পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে। তৃণমূলের তালিকায় যোগ্যদের নাম পাঠানো হয়নি-এমন অভিযোগ করেছেন অনেকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। এভাবে নাম পাঠানোর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
এদিকে যেসব জেলা-উপজেলার নেতারা বিতর্কিত প্রার্থীদের পরিচয় গোপন করে মনোনয়ন বোর্ডে লিস্ট পাঠিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক।
শুক্রবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নের ব্যাপারে কতগুলো স্তর পার করে চূড়ান্তভাবে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের কাছে আসে। কাজেই এদের যারা চিহ্নিত করেনি অথবা এদের পরিচয় যারা গোপন রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
বিএনপি না থাকায় নির্বাচনি মাঠে আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনেও শতাধিক জায়গায় দলের বিদ্রোহীরা মাঠে ছিল। দ্বিতীয় ধাপেও অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে বিতর্কিতরা যেসব ইউপিতে মনোনয়ন পেয়েছে সেখানে বিদ্রোহী থাকার শঙ্কা বাড়ছেই। ইতোমধ্যে মনোনয়ন পাওয়া শতাধিক প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় সভাপতির কাছে চিঠি দিয়ে প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন জমা পড়েছে। পরিবর্তন না করলেও নির্বাচন উন্মুক্ত রাখার দাবিও জানিয়েছে তাদের অনেকেই।
দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরুর পর থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তৃণমূল থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করে। এতে অভিযুক্তদের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। এরপর মনোনয়ন বোর্ডের সভার প্রথম দিন রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর থেকে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে।
একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল সমাবেশও হয়। এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনেও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে।
ধানমন্ডি কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিনই প্রচুর অভিযোগ আসছে। সব জমা নিচ্ছি না। যেসব অভিযোগের সঙ্গে প্রমাণ বা ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে সেগুলোই জমা নেওয়া হচ্ছে। সেগুলো দপ্তর থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে লিখিতভাবে মনোনয়ন বোর্ডের সভায় পাঠানো হয়।
অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে এ পর্যন্ত অন্তত ১২ ইউপিতে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দেশজুড়ে আলোচিত নাসিরনগরের হিন্দু পাল্ল ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত তিন আসামিকে তিনটি ইউপির চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এদের মধ্যে দু’জনকে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধেও মনোনয়নের আগে ও পরে অভিযোগ জমা পড়েছে।
অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, বর্তমান চেয়ারম্যান ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত’ এবং ‘নারী নির্যাতন মামলা’র আসামি। তার বিরুদ্ধে হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও যুবলীগ নেতার বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। সেখানে মনোনয়ন পুনরায় বিবেচনার জন্য আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি মনোনয়ন পরিবর্তন করা না হলে নির্বাচন উন্মুক্ত রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
চাকরি-মনোনয়ন দুই কূলই গেল শিমুলের : দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের রুকিন্দীপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন কামরুন্নাহার শিমুল। ৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় চেয়ারম্যান পদে তাকে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছিল।
দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী ক্যাশিয়ার পদ থেকে অব্যাহতি চান শিমুল। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ৯ অক্টোবর তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহ পার না হতেই সেখানে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহসান কবিরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। ফলে শিমুল হারান দুই কূলই। দলীয় মনোয়নের পাশাপাশি চলে গেছে নিজের চাকরিও।
জানতে চাইলে কামরুন্নাহার শিমুল বলেন, মনোনয়নের জন্য আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। মনোনয়ন ফেরত পেলে আমি উপকৃত হতাম। ইউনিয়নের আমার অনেক সমর্থক আছে। ৯৫ শতাংশ সমর্থক আমার। তদন্ত করে দেখলেই তা জানতে পারবে। আমাকে বাদ দেওয়ার কারণ হিসাবে মনে হচ্ছে- ওরা (মনোনয়নবঞ্চিতরা) হয়তো কেন্দ্রীয় নেতাদের ভুল বুঝিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগের কাজ সবসময় করেছি। কিন্তু চাকরির জন্য পদ-পদবি নেওয়া হয়নি। চাকরির আগে কলেজ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি।
জামালপুর সদরের মেষ্টায় প্রার্থী পরিবর্তন : জামালপুর প্রতিনিধি জানান, সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী ছানোয়ার হোসেন সবুজকে পরিবর্তন করা হয়েছে। ওই ইউনিয়নে নতুন করে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে সদর উপজেলা যুবলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক বদরুল হাসান বিদ্যুৎকে। বৃহস্পতিবার দুপুরে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত চিঠি হাতে পান বলে জানান বদরুল হাসান বিদ্যুৎ।
২০১৬ তে বাবা ছিলেন বিদ্রোহী ২০২১-এ ছেলে নৌকার মাঝি : মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে ইসতিয়াক হোসেন খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এই ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন তার বাবা মো. জাকির হোসেন খান।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করায় বর্তমান চেয়ারম্যান জাকির হোসেন খানকে মনোনয়ন বোর্ড দলীয় মনোনয়ন দেবে না। এমনটি ভেবে কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগ শঠতার মাধ্যমে জাকির হোসেন খানের নাম মনোনয়ন বোর্ডে পাঠিয়েছিল।
এদিকে নবগঠিত ডাসার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও আওয়ামী পরিবারের সদস্য এমন ২৩ জনের নাম পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে একজনও দলীয় মনোনয়ন পায়নি। তার ধারণা কেন্দ্রে তাদের তালিকাটি পাঠানো হয়নি। কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের তালিকা থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছেলেসহ অন্য দলের প্রার্থীও রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে মাননীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মনোনয়ন বোর্ডের সব সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সূত্র: যুগান্তর
এম ইউ/১৬ অক্টোবর ২০২১