সিলেট

‘সিলেটি’ ভন্ড পীর হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৪ কোটি টাকা

সিলেট, ০৯ অক্টোবর – কাউকে ফ্ল্যাট, আবার কাউকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে শতাধিক ভক্ত-মুরিদের কাছ থেকে ‘সিলেটি’ ভন্ড পীর হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় চার কোটি টাকা।

শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারে থাকতে ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে বাগিয়ে নেন নির্মাণ শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতির পদ। তার বিরুদ্ধে আছে সমকামিতার অভিযোগও।

তিনি আর কেউ নন, ভক্তরা চেনেন ‘পীর চিশতি’ নামে। প্রকৃত নাম আব্দুল মুত্তালিব চিশতি। তার পৈত্রিক বাড়ি সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলায়। আস্তানা করেন ঢাকার তুরাগ থানা এলাকায় । দেশজুড়ে ওরস-মাহফিল করে জুটিয়েছেন হাজারও মুরিদ। ওরসে তার পরনে থাকে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। বয়ানের পাশাপাশি পীরের লম্বা মোনাজাতে পাগল হন ভক্তরা। পীরবাদ ও চিশতিয়া ত্বরিকার আড়ালে নিজ ভক্তদেরই বলি দেন তিনি!

শুধু প্রতারণায় ক্ষান্ত থাকেননি পীর চিশতি, ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে সুদর্শন যুবক ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হতেন সমকামিতায়। অনৈতিক এ কাজে আগ্রহীদের নিয়ে দুটি পেজ পরিচালনা করতেন তিনি। পীরবাদ, চিশতিয়া ত্বরিকাকে কৌশল হিসেব ব্যবহার করে গত নয় বছর ধরে চলে তার প্রতারণা আর অনৈতিক কাজকর্ম। তবে শেষ রক্ষা মেলেনি।

শুধু নরসিংদীর একটি গ্রাম থেকে সাত ভক্তকে ফ্ল্যাট ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে পীর চিশতি হাতিয়ে নেন ৩০ লাখ টাকা। প্রতারণার পথ সুগম করতে নির্মাণ শ্রমিক লীগের উচ্চ পদও বাগিয়ে নেন। অভিযোগ আছে, এ পদ পেতে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মহিলা লীগের কোষাধ্যক্ষ শেখ আখতারি বেগম পারুলের সঙ্গে অর্থ লেনদেন করেছেন। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য উঠে এসেছে। যদিও টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পারুল।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকার একটি বাসা থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেফতার হন পীর চিশতি। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ডিবি গুলশান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতারের পরদিন কথিত পীর চিশতিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সোপর্দ করা হয়।

প্রতারণার জন্য রাজনৈতিক পদ পেতে মরিয়া ছিলেন আব্দুল মোত্তালেব চিশতি। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মহিলা লীগের কোষাধ্যক্ষ শেখ আক্তারি বেগম পারুলকে ৬০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এতে আওয়ামী নির্মাণ শ্রমিক লীগে সহ-সভাপতির পদ মেলে তার। আর এ পদকেও প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতে থাকেন তিনি।

আদালত একটি মামলায় চিশতির এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে আরেক মামলায় আরও এক দিনের রিমান্ড শেষে গত ৫ অক্টোবর আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয় তাকে। ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজের প্রতারণা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন পীর আব্দুল মোত্তালেব চিশতি।

কথিত পীর চিশতি যাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তাদের অনেকেই যোগাযোগ করেছেন ডিবি কার্যালয়ে। তাদেরই একজন মহসিন মিয়া (ছদ্মনাম)। তার ভাষ্য, নরসিংদীর রায়পুরার এক ভক্ত তাকে জানান, তাদের গ্রামে পীর আব্দুল মোত্তালিব চিশতির শ্বশুরবাড়ি। সেখানে তার জলসাও ছিল। সেখানে কাউকে প্রাইমারি চাকরি, কাউকে উত্তরা দিয়াবাড়ীতে বাস্তুহারাদের নামে তৈরি করা সরকারি ফ্ল্যাট পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু তাদের কেউ না পেয়েছেন চাকরি, না ফ্ল্যাট। ধরনা দিয়েও তারা ফেরত পাচ্ছেন না টাকা।

অন্যদিকে, আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টসে চাকরিরত এইচএসসি পাস করা সিলেটের এক তরুণী মুঠোফোনে জানান, এনএসআইয়ে (ওয়াচার পদে) চাকরির জন্য নির্মাণ শ্রমিক লীগের মেহেদি নামের এক নেতার মাধ্যমে এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা গেছে পীর মোত্তালিব ও শেখ আক্তারি বেগম পারুলের কাছে। কিন্তু চাকরি না হওয়ায় গরু ও জমি বেচার টাকা ফেরত পেতে ধরনা দিচ্ছেন ডিবি কার্যালয়ে।

ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পীর আব্দুল মোত্তালিব চিশতি জানান, প্রতারণায় হাতিয়ে নেওয়া টাকার ভাগ দিতে হতো ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মহিলা লীগের কোষাধ্যক্ষ শেখ আক্তারি বেগম পারুলকে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, প্রতি সপ্তাহে মোত্তালিব চিশতির বাসায় বসত ওরস-মাহফিল, যেখানে জিকিরের হিড়িক পড়ত নর-নারীদের। লম্বা বয়ান-মোনাজাতে ভক্ত-আশেকানদের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়াতেন তিনি। সর্বসাকুল্যে পবিত্র কোরআনের তিনটি সুরা জানা কথিত পীর আব্দুল মোত্তালিব ধান্দাবাজি আর প্রতারণায় রাজনীতিকেও ব্যবহার করতে ছাড়েননি।

তিনি বলেন, আওয়ামী নির্মাণ শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে বিভিন্ন সরকারি দফতরে যাতায়াত করতেন পীর চিশতি। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেলফি তুলতেন। তাদের নাম ভাঙিয়ে চাকরির সুপারিশের কথা বলে হাতিয়ে নেন অর্থ। তার যাতায়াত ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। একদিকে তিনি পীরবাদের বয়ান করতেন, আরেকদিকে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার জন্য সফর করতেন বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়।

তিনি আরও বলেন, পীরবাদ ও রাজনৈতিক পদবি ব্যবহার করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মাস্টার রোলে চাকরি দেওয়া, রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট স্বল্পমূল্যে বরাদ্দ দেওয়া, দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর অথবা মেয়র প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দেওয়ার নামে একেকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ছয় থেকে ১০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে শতাধিক ভক্ত-মুরিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন প্রায় চার কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে তিনি শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীর শিবপুরে কিনেছেন ২৫ কাঠা জমি, নিজ এলাকায় কিনেছেন ২০ কাঠা জমি।

ডিবি পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, অভিযানে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ‘ঢাকা গে কমিউনিটি’ নামের দুটি ওয়েব পেজ চালাতেন তিনি। পেজ দুটির মাধ্যমে প্রায় ১০০ বয় ফ্রেন্ডের (প্রেমিক) সঙ্গে চালাতেন অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌনাচার। ভণ্ড এ পীরের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। শতাধিক প্রতারিত ভুক্তভোগী লোকচক্ষু ও লজ্জায় অভিযোগ করতে সাহস দেখাচ্ছেন না।

ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ও ডিবি-উত্তরের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, না বুঝে বা জেনে অনেকে বিশ্বাস করে অনৈতিকভাবে টাকা লেনদেন করে থাকেন। সবাইকে অনুরোধ করছি, সতর্ক করছি, অনৈতিক লেনদেন করবেন না। এমন প্রতারণায় ভুক্তভোগীরাও দায় এড়াতে পারেন না।

সূত্র : সিলেটভিউ
এম এস, ০৯ অক্টোবর

Back to top button