‘নির্ভীক’ সাংবাদিকতার পুরস্কারে নোবেল
কর্তৃত্ববাদী সরকারের সঙ্গে টক্কর দিতে যাওয়াটা হয়ত পাগলামি, আর সেরকম কিছু করার ইচ্ছা মারিয়া রেসার ছিলোও না। কিন্তু ফিলিপিন্সের মারিয়া রেসা আর রাশিয়ায় দিমিত্রি মুরাতভকে সেই পাগলামিটাই করতে হয়েছে সাংবাদিকতার দায়িত্বের জায়গায় সৎ থাকতে গিয়ে। সেই পথ ধরেই তাদের হাতে ধরা দিয়েছে শান্তির নোবেল।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইয়ে ‘সাহসী’ ভূমিকার স্বীকৃতিতে শুক্রবার চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাদের নাম ঘোষণা করেছে নরওয়ের নোবেল ইন্সটিটিউট।
ফিলিপিন্সের অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম র্যাপলারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মারিয়া রেসা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নোবেল জয়ের খবর তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
এই পুরস্কারকে সাংবাদিকতার স্বীকৃতি হিসেবে দেখার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, “প্রকৃত ঘটনা ছাড়া কিছুই সম্ভব না… বাস্তব চিত্র ছাড়া একটি পৃথিবী মানে সত্য আর বিশ্বাসহীন একটি পৃথিবী।”
সংবাদমাধ্যম লিখেছে, ফেইসবুকে র্যাপলারের ৪৫ লাখ অনুসারী রয়েছেন। মেধাবী বিশ্লেষণ আর কৌশলী অনুসন্ধানের কারণে পরিচিত হয়ে উঠেছে সংবাদমাধ্যমটি।
ফিলিপিন্সের মাত্র অল্প কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতার্তে এবং তার নীতির খোলাখুলি সমালোচনা করে। সেখানে দুতার্তের বিতর্কিত ও সহিংস মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে সবিস্তারে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে র্যাপলার। এছাড়া প্রেসিডেন্টের নারী বিদ্বেষ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতিরও খবরও প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
সোশাল মিডিয়ায় সরকারের ছাড়ানো মিথ্যা প্রচারে বিষয়ে নিজেই প্রতিবেদন লিখেছেন মারিয়া রেসা। তাকে বেশ কিছু মামলারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার ভাষায়, এসব মামলা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।
শান্তিতে নোবেল পাবেন- এমন প্রত্যাশা রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভেরও ছিল না। টেলিগ্রাম চ্যানেল পডিয়মকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই পুরস্কার ‘রাশিয়ার নিষ্পেষিত সাংবাদিকতার জবাব।”
দিমিত্রি মুরাতভ রাশিয়ার অনুসন্ধানী সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটার সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৩ সালে প্রকাশের পর থেকেই তিনি এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাশিয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এবং বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচক গুটিকয় সংবাদপত্রের একটি এই নোভায়া গেজেটা।
পত্রিকাটি সপ্তাহে ছাপা হয় হয় তিনবার, তাতে নিয়মিতভাবে দুর্নীতির অভিযোগ এবং শাসকদের নানা অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবদেন থাকে। তুলে ধরা হয় নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের চিত্র।
সাংবাদকিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এর তথ্য অনুযায়ী, নোভায়া গেজেটার অন্তত ছয়জন সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে।
চেচনিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিবেদনসহ আরও বেশি কিছু সংবাদের কারণে পত্রিকাটিকে হেনস্তা এবং হুমকি মোকাবেলা করতে হয়েছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভের পর সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ হলে প্রথম রুশ নাগরিক, যিনি শান্তিতে নোবেল পেলেন।
৫৯ বছর বয়সী মুরাতভ দেশটির অনুসন্ধানী সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটার প্রধান সম্পাদক। গর্ভাচেভ ১৯৯০ সালে তার নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। সেই টাকায় কেনা একটি কম্পিউটার এখনও পত্রিকাটির অফিসে প্রদর্শনী হিসেবে রাখা আছে।
১৯৩৫ সালে জার্মান সাংবাদিক কার্ল ফন ওজিয়েতস্কির পর এবারই প্রথম দুই সাংবাদিককে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বেছে নিল নরওয়ের নোবেল কমিটি।
WATCH LIVE: Join us for the 2021 Nobel Peace Prize announcement.
Hear the breaking news first – see the live coverage from 11:00 CEST.
Where are you watching from? #NobelPrize https://t.co/uUWS5CDJOu
— The Nobel Prize (@NobelPrize) October 8, 2021
নোবেল কমিটি যা বলেছে
মারিয়া রেসাকে পুরস্কার দেওয়ার বিষয়ে নরওয়ের নোবেল ইন্সটিটিউট বলেছে, ফিলিপিন্সে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের মুখোশ উন্মোচনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার শক্তিকে ব্যবহার করেছেন এই ফিলিপিনো সাংবাদিক।
“একজন সাংবাদিক এবং র্যাপলারের সিইও হিসেবে রেসা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষের একজন নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে।”
প্রেসিডেন্ট দুতার্তের বিতর্কিত মাদকবিরোধী অভিযানে হত্যার ঘটনাগুলো তুলে ধরতে র্যাপলারের সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরে নোবেল কমিটি বলেছে, “নিহতের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে ওই মাদকবিরোধী অভিযান নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের রূপ পেয়েছিল।”
তাছাড়া ভুয়া খবর ছড়াতে, সরকারবিরোধীদের নাজেহাল করতে, জনমতকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রভাবিত করতে কীভাবে সেখানে সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাও তুলে ধরেছেন রেসা এবং র্যাপলার।“
দিমিত্র আন্দ্রেইভিচ মুরাতভকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে নোবেল কমিটি বলেছে, রাশিয়ায় ক্রমাগত বাড়তে থাকা চ্যালেঞ্জিং এক পরিস্থিতির মধ্যে গত কয়েক দশক ধরে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে আসছেন নোভায়া গেজেটার এই প্রধান সম্পাদক।
“নোভায়া গেজেটা বর্তমানে রাশিয়ায় সবচেয়ে স্বাধীন সংবাদপত্র এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাদের মৌলিক সমালোচনার ভূমিকা রয়েছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এবং একনিষ্ঠ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে এ সংবাদপত্রটি তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে, যেখানে রুশ সমাজের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে খুব কম সংবাদমাধ্যমই সে ভূমিকা রাখছে।”
নোবেল কমিটি বলছে, ১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে থেকে দুর্নীতি, পুলিশের সহিংসতা, বেআইনি গ্রেপ্তার, ভোট জালিয়াতি এবং রাশিয়ার ভেতরে ও বাইরে রুশ সেনাবাহিনীর অনলাইন অপপ্রচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে নোভায়া গেজেটা। সেজন্য নোভোয়া গেজেটার কর্মীদের হেনস্থা, হুমকি, সহিংসতা এবং হত্যার শিকারও হতে হয়েছে।
এ সংবাদপত্রের যে ছয়জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে চেচনিয়া যুদ্ধের আসল পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন লেখা আনা পলিতকোভস্কায়াও রয়েছেন।
নোবেল কমিটি বলেছে, হত্যা আর হুমকির মধ্যেও প্রধান সম্পাদক মুরাতভ সংবাদপত্রটির স্বাধীন নীতিমালা ত্যাগ করেননি। তিনি ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিকতার অধিকারের জন্য লড়েছেন, সাংবাদিকতার পেশাদার এবং নৈতিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে যে কোনো কিছুই লিখতে চেয়েছেন, যা তারা লিখতে চান।
প্রতিবছর চিকিৎসা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছা অনুসারে। তার উইলে শান্তি পুরস্কার পাওয়া যোগ্যতা হিসেবে তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হল দেশে দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, নিরস্ত্রীকরণে সাফল্য এবং শান্তি সম্মিলনে উদ্বুদ্ধ করা।
নোবেল কমিটি বলছে, “আজকের এই সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মুক্ত সংবাদপত্র ছাড়া দেশে দেশে মৈত্রী, নিরস্ত্রীকরণ কিংবা বিশ্বজুড়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া কঠিন। সুতরাং এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারে যে ঘোষণা, তা আলফ্রেড নোবেলে ইচ্ছার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।”
নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসেন বলেন, “বিশ্বে গণতন্ত্র আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যখন ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে; তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা এই আদর্শের জন্য লড়াই করে চলেছেন, সেই সকল সাংবাদিকের প্রতিনিধিত্ব করছেন মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ।”
এন এইচ, ০৯ অক্টোবর