ব্যবসা

অনুমোদন ছাড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন ফস্টার পেমেন্টের

নুরুজ্জামান লাবু

ঢাকা, ০৭ অক্টোবর – বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই পাঁচ বছর ধরে পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে আসছে ‘ফস্টার’ নামের একটি সংস্থা, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকা আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে মানিলন্ডারিংয়েরও। ইতোমধ্যে ফস্টারের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটা করা গ্রাহকদের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার বাধ্যতামূলক। নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছানোর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ স্থানান্তর করে পেমেন্ট গেটওয়ে সেবা দেওয়া সংস্থা। ফস্টার এই সুযোগে প্রায় হাজার কোটি টাকা নিজেদের কাছে আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার পরও ফস্টারের কাছ থেকে অর্থ পায়নি অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ যেন মরার ওপর খাড়ার ঘাঁয়ের মতো অবস্থা! ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করতে না পারে সেজন্য পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এখন অনুমোদনহীন পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানে থাকা প্রায় হাজার কোটি টাকা রয়েছে ঝুঁকিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ফস্টারের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগসহ অন্যান্য বিষয় বিএফআইইউ খতিয়ে দেখছে। অনুসন্ধান শেষে তারা যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই ব্যবস্থা নেবে।’

প্রতিটি পেমেন্ট গেটওয়ে সংস্থাকে কার্যক্রম চালাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আবেদন করার পর বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিলে তারা বৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এগুলোকে বলা হয় পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটর (পিএসও)। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে অনুমোদিত তালিকায় ছয়টি পিএসও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। কিন্তু সেখানে ফস্টারের নাম নেই।

প্রশ্ন হলো, অনুমোদন ছাড়াই একটি পেমেন্ট গেটওয়ে সংস্থা কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন করে আসছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এর কোনও জবাব মেলেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, ‘যাদের অনুমোদনই নেই তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে কীভাবে? লাইসেন্স বা অনুমোদন নিলে তো তালিকায় নাম থাকতো।’

তবে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মন্তব্য, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারে না। কারণ পেমেন্ট গেটওয়ে সেবাদানকারীদের দেখভাল করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকেরই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নিয়ে পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ শুরু করে ফস্টার। দ্রুত বৈধ অনুমোদন নেওয়ার শর্তে তাদের এনওসি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ শুরুর পাঁচ বছর হয়ে গেলেও তারা বৈধ অনুমোদন নেয়নি। এবার মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ ওঠার পর সেই এনওসি বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ফস্টারের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে, এটা সত্যি। তবে এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা ভালো হবে।’

সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, একটি গেমিং প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ লেনদেনের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন তারা। এর অংশ হিসেবে সিআইডি জানতে পারে, ফস্টারের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছে গেমিং প্রতিষ্ঠানটি। পরে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগ জেনে যায়, গেমিং প্রতিষ্ঠান ও ফস্টার একই মালিকানাধীন এবং পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে ফস্টারের কোনও বৈধ অনুমোদন নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য সিআইডিকে জানায়।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে তারা ফস্টারের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ তদন্তের পাশাপাশি কিউকমসহ আরও চারটি প্রতিষ্ঠানের কত অর্থ তাদের পেমেন্ট গেটওয়ের হিসাবে রয়েছে তা জানতে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু এই চিঠির জবাব এখনও পাওয়া যায়নি।

কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ তুলে আসছেন গ্রাহকরা। অভিযোগ রয়েছে, কোনও কোনও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাহকদের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে গত ৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক এসক্রো সিস্টেম চালুর নির্দেশনা জারি করে, যাতে পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পেলেই পেমেন্ট গেটওয়ে সংস্থা তাদের অর্থ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে স্থানান্তর করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নির্দেশনার এই সুযোগই নিয়েছে ফস্টার।

একজন গ্রাহকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ অক্টোবর কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন মিয়াকে গ্রেফতার করার পরও ফস্টারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিউকমের প্রধান নির্বাহীর দাবি, গ্রাহক ও মার্চেন্টের কাছে তাদের ২৫০ কোটি টাকার মতো দেনা রয়েছে। তার অভিযোগ, ফস্টারের কাছে প্রায় ৪২০ কোটি টাকা আটকে আছে তাদের। গ্রাহকের হাতে পণ্য সরবরাহের মাস পেরিয়ে গেলেও ফস্টার তাদের অর্থ দিচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে থাকার কারণেই গ্রাহকের পণ্য সময়মতো সরবরাহ করতে বিঘ্ন হয়েছে তাদের।

রিপন মিয়া দাবি করেন, এসব বিষয়ে কিউকমের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিআইডিকে পৃথক চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তার তথ্যানুযায়ী, তারা মৌখিকভাবে ফস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

ফস্টারের প্রধান নির্বাহী ফখরুল ইসলাম তাদের কাছে কিউকমের অর্থ আটকে থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তা ৪২০ কোটি টাকা নয়, ৩৯৭ কোটি টাকা। গ্রাহকের কাছে পণ্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হতে পারার কারণে তারা অর্থ স্থানান্তর করতে পারছেন না বলে ফখরুল ইসলাম দাবি করেছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘আমরা ফস্টারের দাবির বিষয়টিও খতিয়ে দেখবো।’

এদিকে সিআইডি জানতে পেরেছে, ফস্টার তাদের কাছে আটকে রাখা প্রায় হাজার কোটি টাকার একটি অংশ বেআইনিভাবে স্থানান্তর করে ফেলেছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ অন্য ব্যবসায় লগ্নি করারও অভিযোগ উঠেছে। সিআইডির ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘যেহেতু ফস্টারের অনুমোদনই নেই, তাই তাদের কাছ থেকে এই অর্থ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে।’

ফস্টারের ওয়েবসাইট বলছে, বাংলাদেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরে তাদের কার্যক্রম চালু রয়েছে। ফস্টারের মূল প্রতিষ্ঠান হলো এএসডি টেক বা সিস্টেম সল্যুশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস লিমিটেড। তাদের আইটি, টেলিকমিউনিকেশন সেবা ও ইন্টারনেট প্রোভাইডিংয়ের ব্যবসা রয়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের উদয় টাওয়ারে এর প্রধান কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল মতিনসহ মালিকদের কয়েকজন মালয়েশিয়ায় থাকেন।

অভিযোগ ও অনুমোদনের বিষয়ে ফস্টারের কাছে জানতে চাইলে মুনতাসীর নামে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন। প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে পাঠানো লিখিত প্রশ্নের উত্তরে ফস্টারের ওই কর্মকর্তা জানান, তারা ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন। শিগগিরই তারা লাইসেন্স পেয়ে যাবেন বলে আশা করছেন। পাঁচ বছর ধরে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নেওয়া একটি এনওসি নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন।

কিন্তু ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমে বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কেউ পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করতে পারবে না। যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ দিনের মধ্যে এই লাইসেন্স ইস্যু করার নিয়ম রয়েছে।

এ বিষয়টি তুলে ধরলে ফস্টার কোনও মন্তব্য করেনি। এমনকি মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগের বিষয়েও কোনও মন্তব্য নেই তাদের। তবে কিউকমসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের অর্থ তাদের কাছে সুরক্ষিত রয়েছে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তারা নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে বলে দাবি করেছে ফস্টার।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এইচ, ০৭ অক্টোবর

Back to top button