তামাকে শিশুর কি ক্ষতি হয়?
বাড়ির সদর দরজায় বসে তামাক পাতা বাছছিলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার নজীবপুর গ্রামের মোসাম্মৎ বেরিয়ারা খাতুন। মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল ছয় মাসের মেয়ে সুমাইয়া ধনচের স্টিকে দড়ি দিয়ে বাবার তামাক পাতা গাঁথা দেখছে। এ সব দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই কেঁদে ওঠে সুমাইয়া। মা তাকে শান্ত করার জন্য কোলে টেনে বুকের দুধ খাওয়ায়। কিন্তু তার হাতের কাজ থেমে থাকে না। বাছাই করা তামাক পাতা একের পর এক স্বামীর হাতে তুলে দেয়। তামাক বাছা, গাঁথা, খোলা ইত্যাদি কাজ সকাল থেকে চলে বিকাল পর্যন্ত। মেয়েকে দেখাশোনার লোক নেই। প্রায় আট ঘণ্টা এভাবেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেন তিনি।
তন্দুরের ভেতর একটানা আগুন জ্বলছে। আগুনের তাপ মাঝে মাঝে বাইরেও বেরিয়ে আসছে। এই তন্দুরের মুখে কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার বড়বাড়িয়া গ্রামের আম্বিয়া পাঁচ মাসের মেয়ে আয়েশাকে কোলে নিয়ে খড় দিচ্ছিলেন। আগুনের তাপ আম্বিয়ার শরীরে লাগার সাথে সাথে মেয়ের শরীরেও লাগছিল। গরমে মায়ের কোলে উসখুস করতে থাকে সে। কিন্তু আম্বিয়া তন্দুর ছেড়ে উঠতে পারে না। পাতার গ্রেড ঠিক রাখার জন্য তাপমাত্রা ঠিক রাখতে হবে। জ্বালানির একটু হেরফের হলে পাতার গ্রেড নিম্নমানের হয়ে যাবে। তখন দাম কমে যাবে। গরমের দিনে ৪৮ ঘণ্টা এভাবেই তন্দুরে খড়, লাকড়ি দিতে হয় তাকে। একদিকে তন্দুরের আগুনের তাপ অন্যদিকে তামাক পোড়ার বিষাক্ত অন্যান্য পদার্থ দুই শিশুর জন্য ক্ষতিকর। ক্ষুধায় ছোট্ট আয়েশা মায়ের কোলে থেকেও কেঁদে ওঠে। মেয়ের ক্ষুধা নিবারণের জন্য সেখানেই বুকের দুধ খাওয়ায় আম্বিয়া। তন্দুর থেকে তামাক বের করার পর মেয়েকে কোলে নিয়েই তামাক বাছাই করেন তিনি।
আম্বিয়া বলেন, বেশিরভাগ দিনই মেয়ের শরীর ভাল থাকে না। মাঝে মাঝেই পাতলা পায়খানা করে। দু’দিন পরপরই ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ আনতে হয়। ওষুধ খেলে সুস্থ হয়। আবার কয়দিন পরই সেই অসুস্থই হয়।
তামাক চাষ এলাকার মায়েরা তার ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে এভাবেই তামাক বাছাই, পাতা পোড়ানোর জন্য তন্দুরে লাকড়ি দেয়া, পাতা জাগ দেয়ার কাজ করে। এই পরিবেশে কখনো মায়ের কোলে, কখনো মায়ের পাশে বসে শিশুরা খেলে, মায়ের বুকের দুধ পান করে। এ সময় শিশু শ্বাসপ্রশ্বাস এবং দুধের মাধ্যমে তামাকের বিষাক্ত পদার্থ গ্রহণ করে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক পরিচালক ড. খুরশীদ জাহান বলেন, শিশুকে কোলে নিয়ে মা তামাক পাতা বাছাই এবং অন্যান্য কাজ করায় মা ও শিশু দু’জনেই প্রশ্বাসের সঙ্গে তামাকের বিষাক্ত পদার্থ গ্রহণ করছে।
তামাক বাছাই করা মায়ের বুকের দুধের সাথে শিশু যে জিনিসটি খাচ্ছে তা তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর স্বাস্থ্যের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের গাইনী ও অবস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সামসাদ জাহান শেলী বলেন, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় মা শিশুকে বুকের দুধ পান করালে দুধের মাধ্যমে তিনি তার সন্তানকে নিজের অজান্তে তামাকের বিষাক্ত পদার্থ পান করাচ্ছেন। এই বিষাক্ত পদার্থ দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে শিশুর শ্বাসনালী এবং ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে। মুখে ঘা হয়।
অনেক শিশু এখন তামাক পাতা কুড়ানি
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার বড়গাংদিয়া বাজার। পিচঢালা সরু রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে এই বাজার। বাজারটিতে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে ২৫টি তামাকের গোডাউন। এখানে প্রতি রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় হাট বসে। চলে বেলা ১২টা পর্যন্ত। এই হাটটা গ্রামের অন্যান্য হাটের চেয়ে একটু ভিন্ন। তামাকের বিষাক্ত পদার্থ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তামাক বেচাকেনার হাট হিসাবেই এটি পরিচিত। সকাল হতেই ভ্যানগাড়িতে লোডে লোডে তামাক বোঝাই করে তামাক চাষীরা হাটের গোডাউনগুলোর সামনে এসে একে একে থামে। ক্রেতা বিক্রেতার দর কষাকষি শেষ হতেই তামাকের লোড ভ্যানগাড়ি থেকে গোডাউনে উঠে যায়।
বড়গাংদিয়া বাজারে হাটবারগুলোতে তামাক বেচাকেনার জন্য ক্রেতা বিক্রেতার সরগরম হলেও আরেকটি দৃশ্যও এখানে লক্ষণীয়। একদল শিশুর তামাক পাতা কুড়ানোর দৃশ্য। সকাল ৭টা বাজতেই আশপাশের গ্রামের শিশুরা দল বেঁধে বড়গাংদিয়া বাজারে চলে আসে। গোডাউনের সামনে পড়ে থাকা তামাক পাতা কুড়ায়। হতদরিদ্র পরিবারের এই শিশুরা কুড়ানো তামাক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের সকলের হাতে থাকে একটি ব্যাগ আর একটি খড় অথবা পাতার মুঠি দিয়ে তৈরি ঝাড়। বাম হাতে ব্যাগ আর ডান হাতে ঝাড় নিয়ে তারা ছুটে যায় প্রতিটি গোডাউনের সামনে। সেখানে পরিত্যক্ত তামাক কুড়িয়ে ব্যাগে ভরার আগে ঝাড় দিয়ে তামাক পাতা এক জায়গায় জড় করে। ডান হাতে দ্রুত তামাক ব্যাগে ভরেই আবার ছোটে আরেক গোডাউনের সামনে।
এসব শিশুদের মধ্যে রয়েছে ওমরপুর গ্রামের ঘোড়ামারা দাসপাড়ার কাজলী, সীতা, দীপালী, শিপালী, ডিপজল, কৃষ্ণ দাস প্রমুখ। তাদের বয়স ৫ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে। তামাকের মধ্যে ঘোরাফেরা এবং ধুলোবালি থেকে তামাক পাতা কুড়ানোর সময় তামাকের বিষাক্ত
পাঁচ বছরের ভাই ডিপজলকে নিয়ে তামাক কুড়াচ্ছে এগারো বছরের বোন সীতা। বছর দুয়েক ধরেই সে বড়গাংদিয়া বাজারে তামাক কুড়াতে আসে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সেই বড়। বাবা জুতা সেলাই করে যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে না।
বড়গাংদিয়া বাজারে কথা হলো সীতার সাথে। তামাক কুড়াতে ব্যস্ত সে। কথা বলার ফুসরত নেই তার। তামাক কুড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই সে জানাল, বই খাতা কেনার টাকা নেই। তাই স্কুলে যেতে পারে না। প্রতি হাটবার তামাক পাতা কুড়িয়ে যা পায় তা ব্যবসায়ীদের কাছে আট টাকা কেজি বিক্রি করে। পাঁচ থেকে ছয় কেজি তামাক কুড়াতে পারে। ছোট ভাইও তামাক কুড়ায়। দু’ভাইবোনের বিক্রির টাকা মায়ের হাতে দেয়।
এই বাজারের একটি গোডাউনের সামনে পড়ে থাকা তামাক দেখে ছুটে যায় দু-তিনজন ছেলেমেয়ে। ঝাড়ু দিয়ে একজায়গায় করে ব্যাগে ভরতে না ভরতেই তাদের দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয় গোডাউনের মালিক। সবার সঙ্গে কৃষ্ণও ছিল সেখানে।
কৃষ্ণ দাস (১৩) জানায়, তামাক কুড়ানোর সময় মাঝে মাঝেই গোডাউনের মালিকদের ধমক, তাড়া খেতে হয়। ধমক খেয়েও তামাক কুড়ায় সে। বাবা তামাক ঘর জ্বালায়। দু’দিন দুই রাত জ্বালায়ে ৫০০ টাকা পায়। চার ভাই এক বোন মাকে নিয়ে পরিবারে সাতজন লোক। বাবার প্রতিদিন কাজ থাকে না। কাজ না থাকলে দুবেলা খাবার জোটে না তাদের। পরিবারের আর্থিক সহযোগিতার জন্য প্রতি হাটে তামাক তুলতে চলে আসে সে। পাঁচ কেজি তামাক বিক্রি করে যা পায় তা মাকে দেয়।
স্কুলে যায় কিনা জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, খাবারই জোটে না, পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে যোগাবে বাবা-মা। বই খাতা কেনার টাকা না থাকায় স্কুলে যেতে পারি না।
সকালে কয়টা পান্তা গত খেয়ে সাত বছরের দীপালি বড় বোনের সঙ্গে তামাক কুড়াতে এই বাজারে এসেছে। হাটের দিন মা তাদের এখানে পাঠিয়ে দেয়। দু’বোন মিলে দশ কেজির মতো তামাক কুড়িয়েছে। এও তার সাথীদের মতো তামাক বাজারেই বিক্রি করে টাকা মায়ের হাতে তুলে দেবে।
আরও পড়ুন: অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু ‘প্রতিরোধযোগ্য’
ওমরপুর গ্রামের এসব শিশুরা কেউ তামাক চাষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। এমনকি তামাক চাষী পরিবারের সন্তানও নয়। এরপরও তারা তামাকের বিষাক্ত পদার্থ প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে গ্রহণ করছে তামাক কুড়ানোর কারণে। তাদের অভিভাবকরা জানে না, সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য যে কাজে তার সন্তানকে পাঠিয়েছেন তা তার সন্তানের জীবনায়ুস্কাল কমিয়ে দিচ্ছে। তামাক কুড়ানোর কারণে তারা নানারোগে ভুগছে। এ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই।
ওমরপুর গ্রামের দীপালি শিপালীর মা আরতির সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তামাক মৌসুমে মেয়েরা তামাক কুড়িয়ে দুটো পয়সা সংসারের জন্য রোজগার করে। এই রোজগারের কারণে যে আপনার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা তার শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে তামাকের বিষাক্ত পদার্থ গ্রহণ করছে, যা তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তামাক কুড়াতে গিয়ে অন্যের মার, ধমক খাচ্ছে তা কী আপনি জানেন?
আডি/ ২৬ অক্টোবর