জাতীয়

শাহজালাল বিমানবন্দরে ভয়াবহ কার্গোজট

মুজিব মাসুদ

ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর – শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গোতে পণ্য পরিবহণে ভয়াবহ জট তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ জনবলের অভাব, স্ক্যানিং মেশিন ও ওজন মাপার যন্ত্র বিকল থাকায় এমন জট। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগের ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি কার্গো ডেলিভারি করতে হচ্ছে এখন প্রতিদিন। আগে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি কার্গো ফ্লাইট থাকলেও এখন গড়ে শিডিউল নন-শিডিউল মিলে অর্ধশতাধিক ফ্লাইট ওঠানামা করছে। পণ্য স্ক্যানিংয়ে এখন একমাত্র ভরসা ৪ কুকুরের ডগ স্কোয়াড। যার কারণে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। তবে দু-একদিনের মধ্যে বিকল ইডিএস মেশিন সচল হলে এই জট থাকবে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমন ধীরগতি চলতে থাকলে ঝুঁকিতে পড়বে বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ। অপরদিকে স্ক্যানিংয়ে সমস্যা হলে যে কোনো সময় ফের বন্ধ হয়ে যেতে পারে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কার্গো পরিবহণ।

এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো পরিবহণে ধস নামায় অনেক ক্রেতা তাদের পণ্য পরিবহণে কলকাতা বিমানবন্দর

ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেকে ইতোমধ্যে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে কার্গো পরিবহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে। স্প্যানিশ পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পুল অ্যান্ড বিয়ার এরই মধ্যে তাদের বাংলাদেশি সাপ্লায়ারদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিবর্তে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে যেন তাদের পণ্য পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পরিমাণে বেশি ও বিরামহীন সমস্যার কারণে ঢাকা বিমানবন্দরে স্ক্যানারের জন্য তাদের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাই এই সপ্তাহে তাদের কার্গোর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ (৫০০/১২০০ টন) কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডের পোশাক ক্রেতাদের তুমুল চাহিদার কারণে কনটেইনার কার্গোর চাপ বেড়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এ কারণে বিমানবন্দরকে সক্ষমতার চেয়ে দেড়গুণ বেশি কার্গো সামলাতে হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের কনটেইনার জট এবং চড়া কার্গো শিপিং চার্জের কারণে ক্রেতা ও রপ্তানিকারকরা আকাশপথে পণ্য পরিবহণে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু বিমানবন্দরের দুই স্ক্যানার ও ওজন মাপার মেশিন বিকল থাকায় রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে বড় জট। এছাড়া কার্গো কমপ্লেক্স সংলগ্ন টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় ও কার্গো ভিলেজে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় রপ্তানিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কার্গো ভিলেজের সামনের শেডটি এখন অনেক কোম্পানির গোডাউনে পরিণত হয়েছে। মূলত এই শেডটি মালামাল আনলোডের জন্য তৈরি হলেও অনেকে তাদের পণ্য নিয়ে সেখানে জড়ো করে রাখছেন। অভিযোগ আছে, বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের একটি সিন্ডিকেটকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অসাধু কোম্পানিগুলো শেডে মালামাল জড়ো করে রাখেন।

বিমানবন্দরের পরিচালক গ্র“প ক্যাপ্টেন এসএম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, এয়ারলাইন সক্ষমতা অনুযায়ী দিনে ৬০০-৭০০ টন পণ্য সামলাতে হচ্ছে। যা আগের ধারণক্ষমতার তুলনায় দেড়গুণের বেশি। তিনি বলেন, ‘কার্গো ফ্লাইটের সংখ্যাও বেড়েছে। আগে যেখানে ১৫টি ফ্লাইট হতো এখন বেড়ে ২৫টি হয়েছে।’

ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা জানিয়েছেন, ঢাকা বিমানবন্দর এখন যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে তার ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। তাদের মতে, শিডিউলড ফ্লাইট কম থাকা এবং বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র বিকল থাকায় তাদের পণ্য ডেলিভারিতে নানা সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে পণ্যের জট থাকায় অনেক দূর পর্যন্ত ট্রাকের লাইন তৈরি হয়। এই জট পেরিয়ে সময় মতো মালামাল ডেলিভারি দিতে পারছে না। এতে দেশের বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি কার্গো শিল্প এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

কয়েকদিন ধরে সরেজমিন কার্গো কমপ্লেক্স এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রবেশের জন্য শত শত ট্রাক বিমানবন্দরের বাইরে রপ্তানিপণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাঝে মাঝে ট্রাকের সারি উত্তরা পর্যন্ত চলে যায়। সময়মতো পৌঁছাতে না পারায় প্রতিদিন ফ্লাইট বাতিল করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে পণ্য রপ্তানির খরচ। কার্গো পণ্যের এই জটকে পুঁজি করে বিমানবন্দরে গড়ে উঠেছে একটি অবৈধ সিন্ডিকেট। দ্রুত পণ্য প্রবেশের সুবিধা দেওয়ার কথা বলে এই সিন্ডিকেট ১০০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী।

বাপা সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, নিয়মিত শিডিউল ফ্লাইটের অনুপস্থিতির কারণে রপ্তানিকারকরা বাধ্য হয়ে উচ্চ মূল্যের ফ্রেইটার সার্ভিসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখন সেটাও নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বিমানবন্দরে পণ্য পরিবহণে জটের সৃষ্টি হয়েছে।

বাপার অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম) মেশিন কিনতে খরচ পড়ে ৫-৬ কোটি টাকা। অথচ এই ইডিএস মেশিনের কারণে শত শত কোটি টাকার পণ্যের আদেশ বাতিল হয়ে যায়। এরপরও সরকার ও সিভিল এভিয়েশনের টনক নড়ে না। তিনি আরও বলেন, বাপার পক্ষ থেকে সিভিল এভিয়েশনকে অসংখ্যবার বলা হয়েছে বাপা নিজেদের খরচে এই মেশিন বসাবে, দক্ষ জনবল দিয়ে এই মেশিন পরিচালিত করবে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বসে বসে কমিশন পাবে আর মনিটরিং করবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বাপাকে এই ক্ষমতাও দিচ্ছে না, আবার নিজেরাও কিছু করতে পারছে না। তার মতে, যদি বাপা এটা পরিচালনার সুযোগ পেত তাহলে কোনো পণ্যের জট হতো না। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আরও শক্তিশালী হতো।

বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই জানিয়ে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ কার্গোবাহী সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্য। পরে তাদের পরামর্শে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেডলাইন অ্যাসিউর্ড সিকিউরিটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে বেবিচক। এরপর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়। বসানো হয় আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি। যুক্ত হয় ডগ স্কোয়াড। এরপর যুক্তরাজ্যসহ সব দেশ কার্গো পণ্য পরিবহণে তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

বর্তমানে কার্গো কমপ্লেক্সে থাকা দুটি ইডিএস মেশিন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। পণ্যের চাপ বেশি পড়লে দুটি যন্ত্রেই ত্র“টি দেখা দেয়। জানা গেছে, এক মাস ধরে একটি ইডিএস মেশিন পুরোপুরি নষ্ট। অপর মেশিনটিও বেশির ভাগ সময় বিকল থাকে। ইডিএস মেশিন অচল হওয়ায় ডিএমপির কুকুর (ডগ স্কোয়াড) দিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে (ইডিডি) পণ্য তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হয়। এতে পণ্য রপ্তানিতে ধীরগতি তৈরি হয়। এভাবে পুরো কার্যক্রমে ধস নেমে এসেছে।

করোনার কারণে প্রথম দিকে পণ্য রপ্তানি কম হওয়ায় তেমন সমস্যা হয়নি। তবে কয়েক মাস ধরে পণ্য রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় দুটি ইডিএসে ত্র“টি দেখা দিয়েছে।

ইডিএস মেশিন নষ্ট থাকায় ৩ দিন ধরে ইউরোপে সবজি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সাধারণ সম্পাদক মো. মনসুর। তিনি বলেন, ইডিএস নষ্ট থাকায় প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ টন সবজি বিমানবন্দর থেকে ফেরত আনতে হচ্ছে। এসব সবজি স্থানীয় বাজারে কম দামে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে পণ্য না যাওয়ায় ইউরোপের বাজার হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিএফভিএপিইএর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে লাউ, শিম, চিচিঙ্গা, জালি, পটোল, কাঁকরোল, শসা, কচু, লতি, আমড়া, জলপাই, লেবু ইত্যাদি সবজি ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়।

বাপা সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, এই সময়ে সাধারণত তৈরি পোশাক রপ্তানি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বিস্ফোরক শনাক্তকরণ সিস্টেম (ইডিএস) মেশিন অচল থাকায় পণ্য ডেলিভারিতে বড় জট দেখা দিয়েছে।’ পোশাক রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, পণ্য জটের কারণে মাঝে মাঝে রাতের বেলায় কার্গো ট্রাকগুলোকে কার্গো ভিলেজের বাইরে ৩ থেকে ১০ দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়। এ সময় ট্রাফিক পুলিশ তাদের যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করে। অন্যদিকে গন্তব্যের ভিত্তিতে বিমান ভাড়াও ৬০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে বাংলাদেশ পোশাক পরিবহণের সুবাদে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। গত অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ২.৯৭ বিলিয়ন ডলার। পোশাক আইটেমের সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ার কারণে আগের মাস থেকে আগস্টে যুক্তরাজ্যে খুচরা বিক্রি কমা অব্যাহত ছিল। তবে বর্তমানে বিক্রির পরিমাণ ০.৭ শতাংশ হারে বাড়ছে।

সূত্র : যুগান্তর
এন এইচ, ২৭ সেপ্টেম্বর

Back to top button