অপরাধ

এহসান গ্রুপ ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা!

সানাউল হক সানী

পিরোজপুর, ০৫ আগস্ট – ২০০৮ সালে মাত্র ৯০০ টাকা বেতনে এহসান মাল্টিপারপাস নামক একটি প্রতিষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসেবে চাকরি করতেন মুফতি রাগীব আহসান। এহসান মাল্টিপারপাস দেউলিয়া হলে একই নামে নতুন কোম্পানি চালু করেন রাগীব। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পিরোজপুর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন এহসান গ্রুপ। আর এ কাজে ব্যবহার করেন ধর্মীয় লেবাস। বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল এবং ধর্মীয় জলসার আয়োজন করে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের গ্রুপে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী হিসেবে বাছাই করতেন বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকদের। প্রায় ছয়শ ফিল্ড অফিসার (এফও) এবং লক্ষাধিক গ্রাহকের থেকে টাকা নিয়ে তৈরি করেন ১৭টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুমানিক মূলধন পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা মাঠকর্মী

এবং বিনিয়োগকারীদের। তবে সম্প্রতি একের পর এক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরিয়ে ফেলা হয় টাকা। জেলা প্রশাসনের তদন্তেও দেখা যায় এহসান গ্রুপের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেই টাকা। এ নিয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা কয়েক দফা মানববন্ধন, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলেও ফল জোটেনি।

পিরোজপুর সদরের খলিশাখালী এলাকার আবদুর রব খানের বড় ছেলে মুফতি রাগীব আহসান। ২০০৮ সালেও পিরোজপুর সদরের একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। পাশাপাশি এহসান মাল্টিপারপাস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। কোম্পানিটি গ্রাহকের টাকা নিয়ে চম্পট দিলে ২০১০ সাল থেকে একই নামে এহসান রিয়েল এস্টেট নামে একটি এমএলএম কোম্পানি খোলেন রাগীব। ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ শুরু করেন। পরবর্তী সময় যা এহসান গ্রুপ নামে পরিচিতি পায়। এর অধীনে রাগীব গড়ে তোলে ১৭টি প্রতিষ্ঠান। পরে এহসান গ্রুপ পিরোজপুর বাংলাদেশ নামে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারাদেশে। গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লি., এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর এ মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমী, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদ্রাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক),আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি., মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান, পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে এক লাখ টাকার বিপরীতে গ্রাহকদের মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন দিয়ে প্রায় লক্ষাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা জানান, শুরুর পর কয়েক বছর গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন স্বাভাবিক রাখেন রাগীব আহসান। ২ বছর ধরে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে টালবাহনা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এর পর তাদের অফিসের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি আত্মগোপনে চলে যায় রাগীবসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। আর গ্রাহকরা ঘুরতে থাকেন তাদের দ্বারে দ্বারে।

পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এহসান গ্রুপ : এহসান গ্রুপ প্রতিষ্ঠার সময় সামাজিকভাবে সম্মানিত অনেক পরিচালক ছিলেন। তবে কোম্পানি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব পরিচালককে বের করে দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের অনুর্ভুক্ত করে রূপ দেওয়া পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে। এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুফতি রাগীব আহসান। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রাগীব আহসানের স্ত্রী সালমা বেগম। রাগীব আহসানে শ্বশুর মাওলানা শাহ আলম প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, পিতা আ. রব খান প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, রাগীব আহসানের বোনের স্বামী মো. নাজমুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এ ছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাই আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক, মাহমুদুল হাসান শামিম খান ও খাইরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের সদস্য।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিমাসেই বিভিন্ন ইসলামি জলসার আয়োজন করতেন মুফতি রাগীব। এ ছাড়া বছরে কয়েকবার আয়োজন করতেন ওয়াজ মাহফিলের। এসব অনুষ্ঠানে রাগীবের পছন্দের বক্তারা এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করার অনুরোধ করতেন। মানুষকে আকৃষ্ট করতেন ইসলামি শরিয়াহ অনুসারে নানারকম ব্যবসার বিষয়ে । সাধারণ মানুষ এতে সহজেই আকৃষ্ট হতেন। বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করতেন লাখ লাখ টাকা।

মাঠকর্মীরা গ্রাহকের থেকে এসব টাকা সংগ্রহ করতেন। তবে এখন অনেক মাঠকর্মীই বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন না। ঘরছাড়া এসব মাঠকর্মীর বেশিরভাগই বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম। গ্রাহকদের থেকে লভ্যাংশের কথা বলে টাকা এনে জমা দিয়েছিলেন এহসান গ্রুপে। এখন গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলেও খোঁজ মিলছে না এহসান গ্রুপের কর্ণধারদের। রাজধানী ঢাকা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন তারা।

প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মীদের (এফও) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন গ্রাহকদের থেকে তারা টাকা উত্তোলন করে রাগীব আহসান ও পরিচালনা কমিটির কাছে জমা দিতেন। এ ক্ষেত্রে জমা টাকার বিপরীতে স্লিপ লিখে দিতেন।

ভুক্তভোগীদের একজন আক্কাস হাওলাদার। পেশায় গ্রাম্য ডাক্তার। এলাকার সম্মানিত মানুষ। কিন্তু এখন লোকলজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না। আক্কাস হাওলাদার বলেন, ২৩৫ জনের ৯৮ লাখের বেশি টাকা জমা রেখেছিলাম এহসান গ্রুপে। এখন সবাই আমার কাছে টাকা চায়। দিতে পারছি না। সারাজীবনের সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে।

এলাকার শিক্ষিত তরুণ শহিদুল ইসলাম। রাগীব আহসানের ফাঁদে পা দিয়ে গ্রাহক আনার কাজে যোগ দেন এহসান গ্রুপে। আড়াইশ গ্রাহকের থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা তুলে জমা দেন এহসান গ্রুপে। কিন্তু এখন আর টাকা বা লভ্যাংশ ফেরত দিতে পারছেন না। গ্রাহকরা ধরছেন শহিদুল ইসলামকে। শহিদুল ইসলাম বলেন, জীবনের সব হারিয়েছি। মানুষের টাকা দিতে না পেরে অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কাজ করছি রাজমিস্ত্রির।

একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ফোরকান হোসাইন। ৩৯০ জনের কাছ থেকে টাকা তুলে এহসান গ্রুপে জমা দিয়েছিলেন ২ কোটি ২ লাখ টাকা। গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলেও টাকা দিতে পারছেন না ফোরকান হোসাইন। তিনি বলেন, কোনো উপায় পাচ্ছি না। এহসান গ্রুপের পেছনে পেছনে ঘুরছি। আশ^াস দিয়ে পার করছে অনেক সময়। কবে টাকা ফেরত দেবে, আর কবে এসব থেকে মুক্তি পাব জানি না।

মাওলানা হারুনুর রশিদও একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। এলাকার সবার কাছে সম্মানীয় ব্যক্তি। কিন্তু এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মানুষের থেকেই। পরিবারে অনেকেই অসুস্থ। সেবা-যত্নও করতে পারছেন না। হারুনুর রশিদ বলেন, দুই কোটি টাকার ওপরে জমা দিয়েছি এহসান গ্রুপে। দিনের পর দিন ঘুরতেছি। টাকা দেওয়ার নাম নেই। উল্টো আমাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।

প্রায় চল্লিশজন মাঠকর্মীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। যারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক অথবা কোনো মসজিদের খতিব। সবাই নিজেদের ধ্বংস হওয়া সামাজিক অবস্থান ও অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন।

মাওলানা হারুনুর রশিদ বলেন, ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালনার কথা বলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের আকৃষ্ট করা হতো। বিভিন্ন ওয়াজ ও ইসলামি জলসায় নানা জায়গা থেকে আলেমদের এনে প্রতিষ্ঠানের গুণগান করা হতো। তাই মানুষ এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক, ইমামদের টার্গেট করে মাঠকর্মী বানানো হতো। আর এখন সবার সম্মান নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষের কাছে বিতর্কিত হয়ে গেছি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুফতি রাগীব আহসানের সঙ্গে। বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপ খোলা থাকলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ‘লক্ষাধিক গ্রাহকের প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা আপনি আত্মসাৎ করেছেন। সাধারণ গ্রাহকরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও আপনার থেকে টাকা উদ্ধার করতে পারছেন না। আপনি কারও সঙ্গে যোগাযোগও করছেন না। অভিযোগের বিষয়ে আপনার বক্তব্য দরকার’- লিখিতভাবে এমন মেসেজ পাঠালে তিনি মেসেজটি দেখেও উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন দৈনিক বলেন, আমরা একটি কমিটি গঠন করেছিলাম। সেখানে প্রেসক্লাবের সভাপতিসহ কয়েকজন গণমান্য ব্যক্তি ছিলেন। তদন্তে দেখা গেছে যেসব অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেখানে কোনো টাকা নেই। শুধু কিছু জমি রয়েছে। সেগুলোর মিউটিশন নেই। সেগুলো তারা বিক্রি করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো লেনদেন হয়নি। যদিও গ্রাহকরা বড় অঙ্কের লেনদেনের কথা বলছেন। তাই তদন্ত কমিটি পুনঃগঠন করা হয়েছে। যেখানে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকও প্রতিনিধি রয়েছে।

সূত্র : আমাদের সময়
এন এইচ, ০৫ আগস্ট

Back to top button