মৌলভীবাজার, ০১ সেপ্টেম্বর – মুজিবশতবর্ষে শতভাগ সবুজ প্রকৃতি বির্নিমাণের লক্ষ্যে কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা এলাকায় পতিত ভূমিতে সৃজিত সামাজিক বনায়নকে কেন্দ্র করে উপকারভোগী বাঙালি ও উপজাতি খাসিয়া সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে। হামলা-পাল্টা হামলা, মামলা-পাল্টা মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে কর্মধা এলাকায়।
গত শুক্রবার (২৭ আগস্ট) পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ৯ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে খাসিয়া ও সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের পক্ষে কুলাউড়া থানায় পৃথক অভিযোগ করা হয়েছে। যদিও বনবিভাগ দাবি করছে, রোশনাবাদ মৌজার মোট ৩৪৬০ একর সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে ২ হাজার একর খাসিয়াদের জবরদখলে। বাকি বাঁশমহাল ও প্রকৃতি বনায়নের অংশের থাকা ১৪৬০ একর জায়গা দখল করতে চায় খাসিয়ারা।
এমন উপ্তত পরিস্থিতে অপ্রতিকর ঘটনা এড়াতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে উপজেলা প্রশাসন। মূলত সামাজিক বনায়ন নিয়ে উপকারভোগী কর্মধার বাসিন্দা রফিক মিয়ার নেতৃত্বে বশির মিয়া, হারিছ আলী, হারুন মিয়া, ইসরাইল আলী গংদের সাথে খাসিয়াদের সম্প্রতি বিরোধের সূত্রপাত ঘটে পাহাড়ের ছোট কালাইগিরি নামক স্থানের ৬৫ ও ১০৫ দাগের সরকারি বনভূমির পতিত ১০ হেক্টর জায়গা নিয়ে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২০-২১ মেয়াদে মোট ২০ হেক্টর পতিত জায়গা সামাজিক বনায়নের নামে অনুমোদন দেয় বনবিভাগ। এই ২০ হেক্টরের মধ্যে ছোট কালাইগিরির ১০ হেক্টার জায়গা নিয়ে বনবিভাগের হয়ে বাঙালি এবং খাসিয়াদের মধ্যে বিবাদ লাগে। পতিত ওইসব জায়গায় খাসিয়ারা অবৈধ দখল নিয়ে পান-জুম গড়েতে চায়, অপরদিকে বনবিভাগের কাছ থেকে লিজ পেয়ে সামাজিক বনায়ন করতে চায় উপকারভোগীরা।
ওই ঘটনার রেস ধরে উত্তাপ ছড়ালে প্রশাসনের মধ্যস্ততায় বনবিভাগ, বাঙালি (উপকারভোগী) ও খাসিয়াদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বেঠকে নিজ নিজ দখলকৃত জায়গার বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। এতে উপয়পক্ষের দকলকৃত জায়গা উপকারভোগী হিসেবে বিবেচিত করা হবে বলেও প্রশাসন আশ্বস্ত করে।
বৈঠকের পর বনবিভাগের দখলকৃত প্রায় ৬ হেক্টর পতিত জমিতে সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্যে উপকারভোগী বাঙালিরা গাছের চারা রোপণ করে। কিছুদিন পর মুড়ইছড়া বিটের হোসনাবাদ মৌজার বনায়নের রোপণকৃত প্রায় ২৫ হাজার চারা ডলুছড়া পানপুঞ্জির হেডম্যান লবিংসুমের নেতৃত্বে উপড়ে ফেলে খাসিয়ারা। এতে বনায়নের ৭ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়। এ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠ সামাজিক বনায়নের সদস্যরা। এ ঘটনায় ১০ আগস্ট কুলাউড়া থানায় লিখিত অভিযোগ দেয় বনবিভাগ।
২৪ আগস্ট দিনগত রাতে সামাজিক বনায়নের সদস্যরা খাসিয়াদের বেলুয়া পুঞ্জিতে হানা দেয় বলে দাবি করে খাসিয়ারা। এ সময় প্রায় ২৮০০ পান গাছ কাটা হয়। এ ঘটনায় ২৫ আগস্ট ৮ জনের নাম উল্লেখসহ ৩৫-৪০ জনকে অজ্ঞাত রেখে বেলুয়াপুঞ্জির হেডম্যান হেনরী তালাং থানায় অভিযোগ করেন। পান গাছ কাটার পর খাসিয়া-বাঙালির বিরোধ ফের প্রকাশ্যে আসে। সামাজিক বনায়নের সদস্য ও বনবিভাগকে বনায়নে যেতে তীব্র আপত্তি জানায় খাসিয়ারা।
পান গাছ কাটার বদলা নিতে বেলু ও ডলুছড়া পানপুঞ্জির খাসিয়ারা একত্রিত হয়ে ২৭ আগস্ট ছোট কালাইগিরির বনায়নের উপকারভোগী পাহারাদার স্থানীয় টাট্টিউলী গ্রামের বাসিন্দা ছুরক মিয়া ও আছকির আলীর ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ সময় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সৃজিত বনায়নের ২ শতাধিক গাছ কাটে এবং সেখানে বনবিভাগের একটি ক্যাম্প ভাঙচুর করে খাসিয়ারা। এমনটাই দাবি করেন উপকারভোগীরা।
এ খবরে সমতলে ছড়িয়ে পড়লে মুরইছড়া বাগানের রাস্তা সম্মুখে উপকারভোগীরা জড়ো হয়। সেখানে বাঙালিরা প্রকাশ্যে হামলা চালায় খাসিয়া ও গারো সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের ওপর। ওই ঘটনায় বাঙালিদের হামলায় আহত হন বেলকুমা পুঞ্জির লিভিংস্টোন ইয়ং নিয়ং, লেবেলসন খংজ, ফিডালিয়া লামিন, কুকিজুরী পুঞ্জির বাসিন্দা সিল পংলং ও রেডিমার চেল্লা।
একইদিন কুকিজুরী পুঞ্জির রাজ নংরুম ও মুরইছড়া পুঞ্জির গারো তরুণ উজ্জ্বল এম সাংমাকে ওই স্থানে বেধড়ক মারধর করে বনায়নের উপকারভোগী বাঙালিরা। এ নিয়ে খাসিয়া এবং সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের পক্ষে কুলাউড়া থানায় পৃথক দু’টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
গত শনিবার (২৮ আগস্ট) সামাজিক বনায়নের সদস্যরা মুড়ইছড়া বাগানের সম্মুখে একত্রিত হয়ে পানবহনে আপত্তি করে দিনমজুর বাঙালিরা। এ সময় বেশ কয়েকটি পানের খাঁচা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে সরজমিন ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে যান কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী, অ্যাডিশনাল এসপি (কুলাউড়া সার্কেল) সাদেক কাওছার দস্তগীর ও কুলাউড়া থানার ওসি বিনয় ভূষন রায়। প্রশাসনের পরিদর্শের পরদিন ২৯ আগস্ট থেকে সামজিক বনায়নের উপকারভোগীদের পাহাড়ে যেতে খাসিয়ারা বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
স্থানীয় উপকারভোগী আছকির আলী ও ইসরাইল মিয়া বলেন, বনবিভাগ থেকে আমরা লিজ এনে দীর্ঘদিন থেকে সামাজিক বনায়ন করে আসছি। কিন্তু খাসিয়ারা নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস না করে পুরো পাহাড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার, সামাজিক বনায়নের গাছ কর্তন ও নার্সারির চারা নষ্ট করে পান-জুমের নামে পাহাড় দখলের পায়তারা করছে। খাসিদের উগ্র আচরণের কারণে আমরা সমতল থেকে পাহাড়ের ভেতর বনায়নের জায়গায় যেতে পারছি না। ২০০৪ এর বিধি অনুযায়ী আমরা বনায়ন রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি। কিন্ত খাসিয়ারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের বৈধ সামাজিক বনায়নের কাজে যেতে বাধা দেয়।
স্থানীয় মুড়ইছড়া বন বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার বলেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতির দোহাই দিয়ে আমাদের থামিয়ে রাখা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে বনবিভাগ কোনো সহযোগীতা পাচ্ছে না। আমার জনবল কম। প্রশাসনের সহযোগীতা ছাড়া সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার কিংবা বনায়ন সম্ভব নয়।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বনের ভেতরে সরকারিভাবে সামাজিক বনায়ন করার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তুু খাসিয়ারা এতে বাধা দিচ্ছে। জনবল কম থাকায় গত ১৫ দিন ধরে বনের ভেতরে বনায়নের জায়গায় যেতে পারছি না খাসিয়াদের ভয়ে।
অভিযুক্ত খাসিয়া হেনরি তালাং টু জানান, পুঞ্জি থেকে আমরা পান বিক্রি করতে পারছি না। বস্তির লোকজন আমাদের পুঞ্জি থেকে নামতে পারছে না। অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিনয় ভূষণ রায় বলেন, উভয়পক্ষের অভিযোগ আমার কাছে রয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আমরা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, এখন পরিস্থিতি শান্ত। দু’পক্ষ নিয়ে একটা বৈঠকও হয়েছে। আমরা উভয়পক্ষকে নিয়ে শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে বসবো। সরকারি সম্পত্তি নিয়ে কোনো সংঘাত চাই না। আশাবাদী একটা স্থায়ী সমাধান আসবে।
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এম ইউ/০১ সেপ্টেম্বর ২০২১