জাতীয়

সম্পদের হিসাব দিতে অনীহা আমলাদের

ইউসুফ আরেফিন

ঢাকা, ৩০ আগস্ট – জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অফিস আদেশ জারির দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সম্পদের হিসাব দেওয়ার কোনো তাগিদ নেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কেউই তাদের সম্পদের হিসাব দেননি। অফিস আদেশে হিসাব দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে না দেওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব।

কর্মকর্তারা জানান, চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পর পর ডিসেম্বরে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান রয়েছে। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এ এই বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি কখনই। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনীহার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ এই বিধি বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জনের উৎস সম্পর্কে অন্ধকারেই রয়েছে সরকার। প্রশাসনের একদম উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নপদের কর্মচারীরাও সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিচ্ছেন না। ফলে বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আচরণ বিধিমালা মূলত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় কিংবা বিভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিসাব নিচ্ছে না। তারা যদি নিজেরা সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহ চালু রাখত, তা হলে অন্যরা তাদের অনুসরণ করত। কিন্তু গোড়াতেই গলদ রয়েছে।

তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো দপ্তরগুলোও সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়ে আন্তরিক নয়। এসব দপ্তরই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। তারা যদি বিধিবিধান বাস্তবায়নে আন্তরিক না হয়, তা হলে অন্যরা আন্তরিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সুতরাং আগে মূল দপ্তর/সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আমরা প্রতিবছরই আয়কর জমা দিই। সেখানেই সবার সম্পদের তথ্য থাকে। সুতরাং আলাদা করে হিসাব দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তবুও প্রত্যেক দপ্তর সংস্থার প্রধান চাইলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য। কিন্তু শীর্ষ কর্মকর্তারাই এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেন না। ফলে কেউই হিসাব দিতে আগ্রহী হন না।

গত ২৪ জুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী নিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ দু-একটি মন্ত্রণালয়-বিভাগ, অধিদপ্তর কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে নির্দেশ দেয়। আর বাকিদের কোনো খবরই নেই। তারা এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়নি বলে জানা গেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (শৃঙ্খলা-৪) নাফিসা আরেফীন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১১, ১২ ও ১৩তে সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রয় ও সম্পদবিবরণী দাখিলের বিষয়ে নির্দেশনা আছে। সুশাসন নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী উল্লিখিত বিধিসমূহ কার্যকরভাবে কর্মকর্তাদের অনুসরণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে জোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এমতাবস্থায় ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর আওতাভুক্তদের তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/দপ্তর/অধীনস্থ সংস্থায় কর্মরত সব সরকারি কর্মকর্তার সম্পদবিবরণী দাখিল, উক্ত সম্পদবিবরণীর ডেটাবেজ তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে স্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও বিক্রয়ের অনুমতি গ্রহণের বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর ১১, ১২ এবং ১৩ বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হলো। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীর জমি/বাড়ি/ফ্ল্যাট/সম্পত্তি ক্রয় বা অর্জন ও বিক্রির অনুমতির জন্য আবেদনপত্রের নমুনা ফরম এবং বিদ্যমান সম্পদবিবরণী দাখিলের ছকও চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পদের হিসাব নেওয়ার তাগিদ দিয়ে চিঠি দিলেও তারা নিজেরাই নিজেদের মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের হিসাব নিতে পারেনি। যারা আদেশ দেন তারাই যদি বাস্তবায়ন না করেন, তা হলে অন্যরা বাস্তবায়ন করবেন কোন দুঃখে!

এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠির পর গত ২৮ জুলাই নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার নির্দেশ দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সম্পদবিবরণী জরুরি ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদের সংস্থাপন অধিশাখায় পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন কর্মকর্তা-কর্মচারীও তাদের সম্পদের হিসাব দেননি বলে জানা গেছে।

বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনপ্রশাসনের চিঠির দুই মাস পরও কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শুধু জনপ্রশাসনের চিঠিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগের আওতাধীন দপ্তর সংস্থায় নামকাওয়াস্তে পাঠানো হয়েছে। সম্পদবিবরণী দাখিলের বিষয়ে কঠোর কোনো অবস্থান নেওয়া হয়নি। ফলে ওই চিঠির গুরুত্বই হারিয়ে গেছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি কর্মজীবীদের স্বচ্ছতার বিষয়ে সচেতন করতে হলে সম্পদবিবরণী জমা নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সব জনপ্রতিনিধির সম্পদের হিসাবও সময়ে সময়ে নিতে হবে। তা হলে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা আসবে। তবে এ কাজ একদিনেই সম্ভব নয়। সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যেতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান আগেও ছিল। কিন্তু কেউই হিসাব দিতেন না। আগে ঠিক করতে হবে হিসাব কী অর্থবছর ধরে নেওয়া হবে, না ক্যালেন্ডার বছর ধরে নেওয়া হবে। সবাই যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হিসাব জমা দেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। লাখ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর সম্পদবিবরণী যাচাই করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যদি ৮-১০ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর তথ্য যাচাই করা যায়, তা হলে নিশ্চয়ই সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাবও নজরদারি করা সম্ভব। তবে এ জন্য অবশ্যই পুরো পদ্ধতিটি ডিজিটাইজড করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সবার সম্পদের হিসাব খুব সহজেই মনিটর করা সম্ভব।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দ মিসবাহুল আনওয়ার বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হিসাব দিতে বাধ্য। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সম্পদবিবরণীর হিসাব নেওয়া খুবই জরুরি। আইন কিংবা বিধিবিধান করা হয় স্বচ্ছতার জন্য। কিন্তু সেই বিধি উপেক্ষা করলে বিধি প্রণয়ন করে কোনো লাভ হয় না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আমরা চিঠি দিয়ে সম্পদবিবরণী নিতে সংশ্লিষ্টদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিসাব নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করবে। যাদের অস্বাভাবিক সম্পদের সন্ধান মিলবে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। দুদকেও মামলা হবে। দুদক স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর হিসাব যাচাই করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবারটা হয়তো সম্ভব হবে না। যাদের সম্পদ অস্বাভাবিক মনে হবে, তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে স্ব স্ব মন্ত্রণালয় বিস্তারিত অনুসন্ধান করবে।

মন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়েছিল। তখন ১৭ হাজার ২০৮ জন কর্মচারী সম্পদের হিসাব বিবরণী দিয়েছিলেন। বিভাগীয় মামলায় সাময়িক বরখাস্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে থাকায় ৩৬৮ জন তাদের হিসাব দিতে পারেননি। তবে জমা পড়া হিসাবগুলোও ঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। অর্থাৎ কোনো কর্মচারীর অস্বাভাবিক সম্পদ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখেনি ভূমি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হওয়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিতে পারেনি ভূমি মন্ত্রণালয়।

বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান আচরণ বিধিমালা অনুযায়ীই সবার সম্পদের হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই সম্পদের হিসাব দিতে আগ্রহ দেখান না। তারা এ বিষয়টিকে হয়তো ভয় পান।

কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেককে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কাছে প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের সব কর্মচারী-কর্মকর্তাই এ নির্দেশ অমান্য করছেন।

অবশ্য সম্পদের হিসাব নেওয়ার কাজ চলমান আছে জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম বলেন, আপনি খোঁজ নিলে জানতে পারবেন। আমরা হিসাব নিচ্ছি। আপনি দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে কথা বলেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত (শৃঙ্খলা ও তদন্ত) সচিব এএফএম হায়াতুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সূত্র : আমাদের সময়
এন এইচ, ৩০ আগস্ট

Back to top button