অপরাধ

২ কর্মকর্তার জবানবন্দি: ৩ বছরে ঘুষ দেন ৬৪ কোটি টাকা

দুলাল হোসেন

ঢাকা, ২৬ আগস্ট – ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবেদ হাসান ও রাশেদুল হক হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট সংগ্রহ করতে গিয়ে তিন বছরে ৬৪ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। কমিশনের নামে বিভিন্ন এজেন্টকে তারা এই অর্থ দেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সব কর্মকর্তাই পিকে হালদারের কথামতো চলতেন। পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল সব। গত মঙ্গলবার দুপুরে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন সৈয়দ আবেদ হাসান ও রাফসান রিয়াদ চৌধুরী। এর আগে দুদকের রিমান্ডেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন তারা।

আনান কেমিক্যাল লিমিটেডকে ঋণ প্রদানের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান ও সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরীকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়। দুদকের উপপরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান গত ২২ আগস্ট তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। দুদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর গত মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

জবানবন্দিতে সৈয়দ আবেদ হাসান স্বীকার করেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে বিভিন্ন প্রকার ডিপোজিট সংগ্রহ করার কমিশন হিসেবে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার ও সাবেক এমডি রাশেদুল হকের স্বাক্ষরেই ওই চেক বিলি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নুর মোহাম্মদ, রাসেল, রাজ্জাক কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন।

জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, তিনি ২০০৩ আইআইডিএফসিতে অ্যাকাউন্ট অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সেখানে পিকে হালদার তার সহকর্মী ছিলেন। এর পর পিকে হালদারের কথামতো তিনি ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সিএফও পদে যোগদান করেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সব কর্মকর্তাই পিকে হালদারের কথামতো চলতেন। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডে মূলত পিকে হালদারেরই লোকজন ছিল। পিকে হালদার প্রতিটি বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন এবং ঋণ অনুমোদনে ভূমিকা পালন করতেন। এ ছাড়া পিকে হালদার প্রতি সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে আসতেন এবং এমডি রুমে বসে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যেতেন।

রাফসান চৌধুরী জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ২০১০ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তখন প্রতিষ্ঠানটির এমডি ছিলেন পিকে হালদার। রাশেদুল হক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হওয়ার পর ২০১৫ সালের জুনে তিনিও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যোগ দেন। তিনি প্রথমে রুনাই আহমেদের অধীনে চাকরি করতেন, পরে এভিপি আল মামুন সোহাগের অধীনে ছিলেন।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, তিনি ২০১০ সাল থেকে পিকে হালদারকে চেনেন। ওই সময় পিকে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন। ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যোগদানের পর তিনি পিকে হালদারকে প্রতি সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অফিসে আসতে ও এমডি রাশেদুল হকের রুমে বসে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে দেখেছেন। পিকে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের প্রতিটি বোর্ডসভা ও ইসি কমিটির সভায় আসতেন এবং তার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করতেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং মূলত পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি জানতেন। কারণ প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড সদস্যদের বেশিরভাগই ছিল তার লোক। বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রে পিকে হালদার বিভিন্ন অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের এনআইডি, ট্রেড লাইসেন্স, ঋণ প্রপোজাল, টিআইএন সার্টিফিকেট এবং সিআইবি রিপোর্ট ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল হকের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। রাশেদুল হক তা নাহিদা রুনাই বা আল মামুন সোহাগের হাতে দিয়ে ঋণ প্রপোজাল তৈরি করতে বলতেন। নাহিদা রুনাই ও আল মামুন সোহাগ ওই কাগজগুলো তার হাতে দিলে তিনি কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই পরিদর্শন রিপোর্ট ও মর্টগেজ ব্যতিরেকে ঋণ প্রপোজাল/ইন্টারন্যাল ক্রেডিট মেমো তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর দিতেন। এর পর নাহিদা রুনাই, আল মামুন সোহাগ, সৈয়দ আবেদ হাসান, রাশেদুল হক স্বাক্ষর করে বোর্ডে উপস্থাপন করতেন। বোর্ডে অনুমোদন হওয়ার পর পিকে হালদারের নির্দেশেই ঋণগ্রহীতার হিসাবে এক টাকাও না পাঠিয়ে পিকে হালদারের বেনামি বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ও পিকে হালদারসহ বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে ওই ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হতো।

পিকে হালদারের নিদের্শেই আনান কেমিক্যালে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ প্রদান সংক্রান্ত ইন্টারনাল মেমোতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল হক, এভিপি আল মামুন সোহাগ, সাবেক এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান, কোম্পানি সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান স্বাক্ষর করে পিকে হালদারের নির্দেশে ঋণের অর্থ পিকে হালদারসহ তার বিভিন্ন কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যক্তির হিসেবে প্রেরণ করা হয়।

এর আগে দুদকের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। রিমান্ডে তারা জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, তারা পিকে হালদারের আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করতেন। পিকে হালদার যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিককে ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন। কী প্রক্রিয়া ঋণ মঞ্জুর করেছেন জিজ্ঞাসাবাদকালে তার বিস্তারিত তথ্য দেন।

দুদকের তথ্যানুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট ঋণের পোর্টফোলিও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ এর বিপরীতে সম্পদ রয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার। প্রতিষ্ঠানটিতে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা আদায় অনেকটা অনিশ্চিত।

গত ২৫ জানুয়ারি পিকে হালদার কেলেঙ্কারিতে ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে আনান কেমিক্যালের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে গত ১৬ মার্চ সৈয়দ আবেদ ও রাফসান চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে দুদক।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি পিকে হালদার ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বর্তমানে বিদেশে পলাতক।

সূত্র : আমাদের সময়
এন এইচ, ২৬ আগস্ট

Back to top button