সিলেট

সরকারি টাকায় কাউন্সিলর ইলিয়াছের ‘ব্যক্তি উন্নয়ন’!

সিলেট, ২৪ আগস্ট – সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছের ব্যক্তিস্বার্থে ইউনিয়নের আওতাভুক্ত জায়গায় প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। যার পুরো অংশই চা বাগানের জায়গার উপর, অর্থাৎ নগরীর বাইরে।

এছাড়া ইলিয়াছের মালিকানাধিন ভূমি রক্ষায় নির্মাণ করা হয়েছে গার্ড ওয়ালও।

সিটি কর্পোরেশনের টাকায় ইউনিয়নের উন্নয়নের বিষয়টি সৌন্দর্য্যবর্ধন, দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরে আড়ালের চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ভবিষ্যতে এসব এলাকা সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হবে এমন চিন্তা থেকে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ বেআইনি। এলাকাবাসীও এ বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা, আওয়ামী লীগ নেতা ও বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- গোয়াবাড়ি বাজারের আশপাশের বেশকিছু জমির মালিক স্থানীয় কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছ। যার পাশ দিয়ে গেছে গোয়ালিছড়া। গোয়ালিছড়া মূলত আলীবাহার চা বাগান থেকে উৎপত্তি। পরে এই ছড়া তারাপুর চা বাগানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঢুকেছে। ছড়ার সম্পূর্ণ মালিকও সিটি কর্পোরেশন নয়। গোয়াবাড়ি বাজারে কাউন্সিলর ইলিয়াছের পারিবারিক জায়গাটিও সিটি কর্পোরেশনে বাইরে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অথচ এই জায়গায় ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি প্রশস্তের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি গোয়াবাড়ি এলাকায় গিয়ে আরও দেখা যায়, কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমানের বাড়ির বিপরীত পাশে তারই জায়গায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। এই জায়গাটিও সিটি কর্পোরেশনের আওতার বাইরে।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, সিলেট মহানগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১১টি ছড়া দখলমুক্ত করার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কালীবাড়ি ছড়ার দু’পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দুই পাশে ১ হাজার ৭৫০ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সাত ভাগে টিকাদাররা রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ করেন। এরপর ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে ছড়ার পূর্বপাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৭৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে ওয়াকওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

নির্মাণাধীন ওয়াকওয়ের একাংশ তারাপুর চা বাগানের জায়গায় এবং অপর অংশ আলীবাহার চা বাগান ঘিরে। দুটো চা বাগানই ইউনিয়নের জায়গায়। পাঠানটুলা থেকে তারাপুর বাগানের মধ্য দিয়ে গোয়াবাড়ি বাজারে প্রবেশ করা সড়কটির কারণে নির্মাণাধীন ওয়াকওয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। আলীবাহার চাবাগান অংশে নির্মাণ হওয়া ওয়াকওয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এটি উদ্বোধনের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের শিডিউল চাওয়া হয়েছে। তবে এখনও উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ হয়নি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে তারাপুর চাবাগানের তৎকালীন সেবায়েত ডা. পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বাগানের জায়গায় সিটি কর্পোরেশনের ড্রেন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে আপত্তি জানিয়ে জেলা প্রশাসকে অবগত করেন। জেলা প্রশাসন বিষয়টি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে একটি চিঠি দেন।

তবে, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী অংশুমান ভট্টাচার্য্য বিষয়টি স্বীকার করলেও এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাগান কর্তৃপক্ষের আপত্তির মূল বিষয় ছিল- ওয়াকওয়েতে হাটতে গিয়ে দর্শনার্থীরা চা গাছের পাতা ছিঁড়বে। এতে চা গাছের ক্ষতি হবে। বিষয়টি মিমাংসা হয়েছে। চা বাগানের সুরক্ষায় নেট লাগানো হবে যাতে দর্শনার্থীরা চা পাতা ছিঁড়তে না পারেন।’

সিসিক’র প্রকৌশল বিভাগ জানায়, গোয়াবাড়ী থেকে স’মিল পর্যন্ত ২৩৪ মিটার জায়গায় ওয়াকওয়ের নিচে ও বিপরীত পাশে ১৭৬ মিটার দৈর্ঘ্যের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬৬ লাখ বা তারও বেশি।

বাজারের অংশে ১৭৬ মিটার দৈর্ঘ্যরে সম্পূর্ণ জায়গার মালিক স্থানীয় কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান। বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা এমনটাই জানিয়েছেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে সিসিকের একটি সূত্র জানায়, মূলত কাউন্সিলরের এই জায়গা সুরক্ষায় অন্যান্য প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও জাতীয় শ্রমিকলীগ সিলেট সদর উপজেলা শাখার সভাপতি মকবুল হোসেন খান জানান, তার জানা মতে স’মিল থেকে করেরপাড়া পর্যন্ত নির্মিত ওয়াকওয়ে চা বাগানের। সিটি কর্পোরেশন কী কারণে ইউনিয়নের মধ্যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বিষয়টি তার জানা নেই।

ওয়াকওয়ে প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ঢাকার এস.এস.ই এন্ড এস.ই.জে.বি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের অধীনে ৬ ফুট প্রস্তের ওয়াকওয়ের দৈর্ঘ্য ৭৮৫ মিটার। আরসিসি ঢালাই (হাটারপথ), দু’পাশে রেলিং, লাইটিং, দু’টি কালভার্ট রয়েছে এই প্রকল্পে।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী অংশুমান ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, ‘ছড়াটির ‘কিছু অংশ’ সিটির বাইরে হলেও পুনরায় এটি সিটি কর্পোরেশনে প্রবেশ করেছে। মূলত ছড়ার স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে এই অংশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।’ মূলত নগরবাসীর হাটাহাটির সুবিধা নিশ্চিত করা ও চাবাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বড় অঙ্কের খরচ করতে হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

স্থানীয়রা বলছেন, সিটির অভ্যন্তরে ছড়ার বিভিন্ন অংশ দখল হচ্ছে। ছড়ার ঝুঁকিপূর্ণ অংশে সিসিকের নজর না থাকলেও সিটির বাইরে গিয়ে উৎসমুখে এতো টাকা খরচের রহস্য বোঝা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আগে আমাদের জানা ছিল না, এখন জানলাম। তবে, সিটি কর্পোরেশনের বর্ধিত সীমানার মধ্যে এই অংশটিও পড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উন্নয়ন দেশের জন্য, জনগণের জন্য। এটি সিটির বাইরে হলেও মানুষের উপকারের জন্য করা হয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই।’

গোয়াবাড়ি বাজারের একটু সামনে কচুয়ারপাড় এলাকায় সড়কের পাশে কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমানের বাড়ি। বাড়ির বিপরীত দিকের জমিটিও তার মালিকানাধীন। ছড়া রক্ষার নামে কাউন্সিলরের মালিকানাধীন জায়গা পর্যন্ত সড়কের পাশে একটি বক্স ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ, অন্য সব জায়গাতেই ড্রেন খোলা রাখা হয়েছে। সম্প্রতি কাউন্সিলের বাড়ি পাশের জায়গার সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ শুরু করেছে সিসিক।

সীমানাপ্রাচীর ডিজাইন করেছেন সিসিকের সহকারী প্রকৌশলী অংশুমান। প্রাচীর নির্মাণের কাজও এগিয়েছে। রড বসানো হয়েছে পিলার স্থাপনের জন্য। ইটও নিয়ে রাখা হয়েছে। তবে, অংশুমান ভট্টাচার্য্য বলছেন, কাউন্সিলর ইলিয়াছ ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের জায়গার সীমানাপ্রাচীরের কাজ শুরু করান। ঠিকাদার পরিচিত হওয়ায় তাদের অগোচরে এই কাজ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন জেনেছি তখনই কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। কাজের মালামাল সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কাউন্সিলের জায়গার সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ সিটির কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।’ তবে, বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, এখনও পাশেই ইট রাখা আছে।

এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছের বক্তব্য জানতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের সীমানায়। অপরপ্রান্তে বাগান থাকলেও ওয়াকওয়ে সিটির জায়গায়।’

তারাপুর চাবাগান কর্তৃপক্ষ ওয়াকওয়ে নির্মাণে আপত্তি জানালেও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।

গোয়াবাড়ি বাজারে তার জায়গার গার্ডওয়াল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছড়া সংরক্ষণের জন্য সব জায়গায় গার্ড ওয়াল হচ্ছে। এখানে কার জায়গা পড়েছে তা মূখ্য বিষয় নয়।’

একইসঙ্গে তিনি নিজের বাড়ির পাশে সম্প্রতি শুরু হওয়া সীমানাপ্রাচীর নির্মাণেও সিটির টাকা খরচ করার বিষয়টি অস্বীকার করে নিজের টাকায় নির্মাণ করছেন বলে দাবি করেন।

সূত্র : সিলেটভিউ
এন এইচ, ২৪ আগস্ট

Back to top button