ইসলাম

আশুরার ফজিলত করণীয় ও বর্জনীয়

মহররমের ১০ তারিখ তথা আশুরায় ইসলামি শরিয়তের মানদণ্ডে তাৎপর্য, ফজিলত যেমন আছে তেমনি কিছু করণীয় ও বর্জনীয় কাজও রয়েছে। যা সমাজে প্রচলিত। আশুরার এসব তাৎপর্য, ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো কী?

মহান আল্লাহ তাআলার কাছে বছরের বেশ কিছু দিন মাস ও মুহূর্ত বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন। এসবের মধ্যে হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ ইয়াওমে আশুরাও একটি। এই আশুরা শব্দটি আরবি। এটি অর্থ দশম। শব্দটি হিজরি বর্ষের ১০ তারিখকে বুঝায়। হিজরি বছরের হিসেব মতে আগামী ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে আশুরার শুভক্ষণ। যা শুক্রবার সন্ধ্যা তথা সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

আশুরার তাৎপর্যপূর্ণ ফজিলত
ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে অনন্য আশুরা। আশুরার অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ফজিলত আছে। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-

১. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনাতে এলেন তখন ইয়াহুদিগণ আশুরার দিন রোজা রাখতেন। তারা জানাল, এ দিন মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেন, মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার দিক থেকে তাদের চেয়ে তোমরাই অধিক হাকদার। কাজেই তোমরা (আশুরার দিন) রোজা রাখ।’ (বুখারি)

২. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আশুরার দিন সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন, এই দিন জাহেলি যুগের লোকেরা রোজা রাখত…।’ (মুসলিম)

৩. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আশুরার রোজা রাখতেন।’ (মুসলিম)

আফসোসের বিষয়!
অনেক মানুষই জানে না যে, আশুরার করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো কী? এ দিনটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে পালন করতেন? এ দিন সম্পর্কে তিনি কী বলেছিলেন?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের প্রতিটি বছর আশুরার রোজা রাখতেন। সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে রোজা রাখতেন। আবার এ দিনে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির মহররম মাসের ১০ তারিখ কারবালার প্রান্তরে তাঁরই প্রাণপ্রিয় নাতি হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বিপথগামী ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।

তবে ইসলামের ইতিহাসে আশুরার ফজিলত কারবালার জন্য ফজিলতপূর্ণ নয়; কিংবা আশুরার কারণে হজরত ইমাম হুসাইন শাহাদাত বরণ করেছেন এমনটিও নয়; বরং ইয়াজিদ বাহিনীর অবৈধ রাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ইসলামি খেলাফতের পক্ষে কথা বলায় অন্যায়ভাবে নিরাপারাধ হজরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ৭০ জন সঙ্গী-সাথীকে হত্যা করে।

আশুরায় করণীয়

১. আশুরার দিন রোজা রাখা
আশুরার দিন রোজা রাখলে এক বছরের সগিরাহ গোনাহ মাফের আশা করেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি। হাদিসের বর্ণনায় তা ওঠে এসেছে-
হজরত আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আশুরার দিনের রোজার দ্বারা আমি আল্লাহর কাছে বিগত বছরের গুনাহ মাফের আশা রাখি।’ (মুসলিম, তিরমিজি)

আশুরার রোজা রাখার পদ্ধতিও ঘোষণা করেছেন বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখ; ইয়াহুদিদের মতো নয়; আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমাদ)

২. ক্ষমার ঘোষণা
আশুরার দিন ও মহররম মাসজুড়ে বেশি তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা এ দিন ও মাসের বিশেষ মুহূর্তে তাওবাহ-ইসতেগফারে আল্লাহ তাআলা পুরো জাতিকে ক্ষমা করে দেবেন। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মহররম হলো আল্লাহ তাআলার (কাছে একটি মর্যাদার) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতিতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)

৩. ত্যাগ ও কুরবানির শিক্ষা গ্রহণ
দ্বীন ও ইসলামের কল্যাণে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবন থেকে আত্মত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করা সব মুসলমানের জন্য একান্ত করণীয়। যাদের মাঝে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ ঈমানি চেতনা জাগরিত হলেই ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় আসবে।

৪. আশুরায় রোজাদারকে ইফতার করানো
এমনিতে ইফতার করানো অনেক ফজিলতপূর্ণ কাজ। সম্ভব হলে আশুরার দিনে নিজে রোজা রাখার পাশাপাশি রোজা পালনকারীদের ইফতার করানো উত্তম। সাধ্যমত দান-সাদাকাহ করা। গরিবদেরকে পানাহার করানো। ইয়াতিমের প্রতি সদয় ব্যবহার ও সহযোগিতা করা।

আশুরায় বর্জনীয়
১. হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্মরণে কাল্পনিক তাযিয়া বা নকল কবর বানানো থেকে বিরত থাকা।
২. তাযিয়া বানিয়ে তা কাঁধে বা যানবাহনে বহন করে মিছিলসহ সড়ক প্রদক্ষিণ করা থেকেও বিরত থাকা।
৩. নকল এসব তাযিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকা এবং এসব তাযিয়া বা নকল কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ দান করা থেকেও বিরত থাকা।
৪. নিজেদের দেহে আঘাত বা রক্তাক্ত করা থেকে বিরত থাকা।
৫. শোক বা মাতম করা থেকে বিরত থাকা।
৬. যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা থেকে বিরত থাকা।

৭. হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে বিলাপ, মাতম কিংবা মর্সিয়া ও শোকগাঁথা প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বুকে পেটে পিঠে ছুরি মেরে রক্তাক্ত করা থেকেও বিরত থাকা।

৮. ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের বাদ্যযন্ত্রের তালে প্রদর্শনী থেকে বিরত থাকা।

৯. হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহুর নামে ছোট বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক বানিয়ে ভিক্ষা করানো। এটা করিয়ে মনে করা যে, ঐ বাচ্চা দীর্ঘায়ু হবে। এটাও মহররম বিষয়ক এ কু-প্রথাও বটে।

১০. আশুরায় শোক প্রকাশের জন্য নির্ধারিত কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরা থেকে বিরত থাকা।

১১. আশুরা বা ১০ মহররমকে কেন্দ্র করে এসব প্রচারণা থেকে বিরত থাকা জরুরি-

> ১০ মহররম পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়।
> কেয়ামত সংঘটিত হওয়া।
> হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামের সৃষ্টি। বেহেশতে প্রবেশ। আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হওয়া।
> হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আগুন থেকে নাজাত।
> হজরত নুহ আলাইহিস সালামকে মহাপ্লাবন থেকে নিষ্কৃতি ও পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস।
> এই দিনেই অত্যাচারী শাসক নমরূদের ধ্বংস।

উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে আশুরার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং মিথ্যা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহান্নামে নিজেদের ঠিকানা বানানো থেকে বিরত থাকাই জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আশুরার ফজিলত পেতে করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। বর্জনীয় ও মিথ্যা ঘটনা বর্ণনা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এম এউ, ১৬ আগস্ট

Back to top button