যেভাবে সিলেট থেকে আফগানিস্তান গেলেন রাজ্জাক
সিলেট, ১৬ আগস্ট – সিলেট নগরের লামাবাজার এলাকায় ভাইয়ের বাসায় থাকতের আব্দুর রাজ্জাক (২০)। ওই এলাকারই মদনমোহন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন। স্বভাবে নম্র ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। কারো সাথেই কোনো বিরোধ নেই। সেই রাজ্জাক হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান গত ২৫ মার্চ।
‘বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছি, দুদিন পর ফিরে আসবো’- ভাইকে এমনই বলে সেদিন বাসা থেকে বের হয়েছিলেন রাজ্জাক। এরপর আর ফেরেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ভাইকে না পেয়ে গত ১ এপ্রিল সিলেট কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রাজ্জাকের বড় ভাই সালমান খান।
পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ শাখা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ (সিটিটিসি) বলছে, তালেবানদের হয়ে লড়তে আফগানিস্তান পাড়ি জমিয়েছেন রাজ্জাক।
রাজ্জাকদের মূল বাড়ি কুমিল্লার বঙ্গুরা থানায়। তবে ছোটবেলা থেকেই সিলেটে ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতেন তিনি। নগরের দি এইডেড হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছেন।
নগরের লামাবাজারের বিলপাড় এলাকার যে বাসায় থাকতেন রাজ্জাক রোববার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাসায় রাজ্জাকের ভাইসহ তার পরিবারের কেউ নেই। মোবাইল ফোনে কথা হয় রাজ্জাকের বড় ভাই সালমান খানের সাথে। পেশায় তিনি মাইক্রোবাস চালক।
সালমান বলেন, সাম্প্রতিক লকডাউনে চাকরি হারিয়েছি। তাই মাস দুয়েক আগে সিলেট থেকে পরিবার নিয়ে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি।
ভাই কোথায় আছে জানেন না জানিয়ে সালমান বলেন, পুলিশও কোনো খোঁজ দিতে পারছে না। তবে শনিবার থেকে কয়েকজন সাংবাদিক ফোন দিয়ে তার তথ্য নিয়েছে।
তিনি বলেন, এক পুলিশ বলেছেন সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। আফগানিস্তানে চলে গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সালমানের ভাষ্যমতে, ছোটবেলা থেকেই নামাজ পড়তেন রাজ্জাক। বন্ধুদের সাথে তাবলিগে যেতেন। পরবিারের অন্যদেরও নামাজ পড়তে বলতেন। ইসলামী রীতি অনুসারে জীবনযাপন করতে বলতেন।
তার মতে, রাজ্জাকের বন্ধুরাও খুব ভালো। তাদের সকলকেই আমরা চিনি। একটাও খারাপ ছেলে নেই। এলাকার সকলেও রাজ্জাককে ভালো ছেলে হিসেবেইে চেনে।
ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে সালমান বলেন, ২৫ মার্চ সে আমাকে জানায় তার এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে। দুদিন পর ফিরে আসবে। বন্ধুর বাড়ি সিলেটের লালাবাজারে। একটা মাদ্রাসায় পড়ে। নামটা এখান ভুলে গেছি। কিন্তু দুইদিন পেরিয়ে গেলেও সে ফিরে আসেনি। ওই বন্ধুর বাসায়ও সে নেই। এমনকি ওই বন্ধুও নিখোঁজ রয়েছে। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ১ এপ্রিল থানায় জিডি করি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেই।
সালমান বলেন, রাজ্জাক মাঝেমাঝেই বন্ধুদের বাড়ি যেত। থাকতও অনেক সময়। এরপর আবার ফিরে আসতো। তবে এবার আসেনি। তার সেই বন্ধুটিরও খোঁজ মিলছে না।
রাজ্জাকের নিখোঁজের ব্যাপারে থানার ভাইয়ের করা সাধারণ ডায়েরি তদন্ত করছেন নগরের লামাবাজার থানার ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আল আমিন। তিনি বলেন, রাজ্জাকের মোবাইল নাম্বার ট্রেস করে আমরা তার সর্বশেষ অবস্থান দেখতে পেয়েছি নগরের কোতোয়ালি ও জালালাবাদ থানার মধ্যবর্তী খালপাড় নামক একটা স্থানে। ওই জায়গায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর আর তাকে ট্রেস করা যাচ্ছে না। এখন বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি, সে তালেবানের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে আফগানিস্তান চলে গেছে। তবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।
রাজ্জাক যে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, তার বাড়ি লালবাজারে বলে রাজ্জাকের ভাই সালমান জানিয়েছিলেন। তবে এসআই আল আমিন বলেন, ওই ছেলের বাড়ি মৌলভীবাজারে। তার নাম ফরিদ উদ্দিন। তাকে কিছুদিন আগে ঢাকার একটি মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সে এখন কাশিমপুর কারাগারে আছে।
এসআই আল আমিনের ধারণা ফরিদ উদ্দিনের দেওয়া তথ্য থেকেই রাজ্জাকের আফগানিস্তান যাওয়ার তথ্য জেনে থাকতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো টিম। তবে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চত নন বলে আবারও জানান।
সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম ফরহাদ হোসেন বলেন, একটি ছেলে নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগে বেশ আগে একটা জিডি হয়েছিলো। তবে তার সন্ধান আমরা পাইনি। সে কোথায় আছে তাও বলতে পারবো না।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘সম্প্রতি কয়েকজন বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে গিয়েছে। তাদের তিনজনের নাম পেয়েছি। তাদের একজন রাজ্জাক।’
আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন দেশটির মুজাহিদিনরা আশির দশকে যুদ্ধ করেছে, তখনও বাংলাদেশ থেকে কওমিপন্থিদের একটি দল সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আর ৯০ দশকে তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার উদ্ভব। ৯০ দশকে বিএনপি শাসনামলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা কাবুল দখল করার সময়ও বাংলাদেশ থেকে একদল লোক আফগানিস্তানে যায়।
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই দেশটি আবার তালেবানের দখলে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আশঙ্কা করছিল ৯০ দিনের মধ্যে এই ঘটনাটি ঘটবে। তবে তার আগেই পতন হলো কাবুলের। শুরুর দিকে লড়াই হলেও গত কয়েক দিনে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছে সরকারি বাহিনী।
সূত্র : সিলেটটুডে
এন এইচ, ১৬ আগস্ট