অপরাধ

বাংলা সিনেমা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ভিআইপিদের সঙ্গে প্রতারণা

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়

ঢাকা, ১৪ আগস্ট – একজন ভিভিআইপি ও ভিআইপিদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন। এরপর ইমো অ্যাপের মাধ্যমে সেই নম্বরগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করতেন। অপরজন আত্মীয় সেজে এসব নম্বরে নারী কণ্ঠে কথা বলতেন। আলাপের এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে অসুস্থতাসহ নানা সমস্যার কথা বলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা।

এমনই অভিনব প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন মো. আলী আকবর হীরা (৫১) ও তার ছেলে মো. শেরে আলী জিতু (২০)। সম্প্রতি রাজধানীর কোতোয়ালী থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল ফোন ও চারটি সিম। এছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জিতু ভিআইপি বা বিশেষ সিরিজের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন। এরপর অভিনব কায়দায় জেনে নিতেন সেই নম্বর ব্যবহারকারীর নাম-পরিচয়। পরে তা তুলে দিতেন বাবা হীরার হাতে। এরপর হীরা মোবাইলের ‘ম্যাজিক ভয়েস’ অপশন ব্যবহার করে আত্মীয় পরিচয়ে ফোন করতেন সেসব নম্বরে। সাধারণ কিছু আলাপচারিতার পর দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে জরুরি হাসপাতালে নেয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে বলতেন। এভাবে তাদের প্রাথমিক ফাঁদে কেউ পা দিলে শুরু হতো ধাপে ধাপে টাকা আদায়।

স্বজনকে সাহায্যের কথা বলে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা নেয়ার পর, আবার কল দিয়ে বলতেন, ‘ভুল করে ৫ হাজার চেয়েছি আসলে ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন।’ ১০ হাজার টাকা পাঠানোর পর ভিন্ন কৌশলে আরও টাকা আদায় করতেন। যতক্ষণ না ভুক্তভোগী বুঝতে পারছেন যে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এভাবে টাকা আদায় চলতে থাকত বাবা-ছেলের।

গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে দুজন জানিয়েছেন, বাংলা সিনেমা দেখে তারা এমন অভিনব প্রতারণা শিখেছেন।

ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস অর্জন
বাবা ছেলের প্রধান টার্গেট থাকতেন বিভিন্ন ভিভিআইপি সিম ব্যবহারকারী। তাই তারা ভিভিআইপি সিম সিরিজের নম্বরগুলোতে ক্রমানুসারে এক এক ডিজিট পরিবর্তন করে কল করতেন। কল করার আগে ইমো অ্যাপের মাধ্যমে সেই নম্বর ব্যবহারকারীর নাম জেনে নিতেন। কল রিসিভ করার পর নারী কণ্ঠে কথা বলে দূর সম্পর্কের আত্মীয় পরিচয় দিতেন। এভাবে ধীরে ধীরে ভুক্তভোগীদের কাছে বিশ্বাস অর্জন করতেন।

ই-ট্রানজেকশন স্টেটমেন্ট
অপরাধের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তারা ই-ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে কোনো পারসোনাল নম্বরে টাকা লেনদেন করতেন না। তারা বাসার পাশের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নম্বরের মাধ্যমে টাকা তুলে নেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সেই টাকা এজেন্টের কাছ থেকে নিজেদের নগদ অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নিতেন। পরে প্রয়োজন মতো বিভিন্ন সময়ে সেই টাকা তুলে খরচ করতেন। তাদের এলাকার বিভিন্ন ই-ট্রানজেকশন এজেন্টের দোকানগুলোর ক্যাশ আউট স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে অস্বাভাবিক এই লেনদেনের প্রমাণ মেলে।

প্রতিবেদকের হাতে আসা একটি নথিতে দেখা গেছে, 017111**, 016111**, 019111*** সিরিয়ালের নম্বর সংগ্রহ করেন জিতু। নথিতে উল্লেখ থাকা ১৭টি নম্বর থেকে বাবা-ছেলে মিলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে ডিবি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, সম্প্রতি এক নারী এই চক্রের হাতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়কে হাসপাতালে ভর্তির কথা বলে তার কাছ থেকে চারটি ধাপে ২০ হাজার টাকা নেয় চক্রটি। টাকা নেয়ার পর মোবাইল বন্ধ করে দিলে ওই নারী বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এরপর ওই নারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন রাজধানীর কাফরুল থানায়। মামলার তদন্তে বেরিয়ে আস বাবা-ছেলের এমন কীর্তি।

জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, বাবা-ছেলে মিলে একটি চক্র তৈরি করেছে। তারা গত সাত বছর ধরে এই প্রতারণা চালিয়ে আসছিল। প্রতারণাই ছিল তাদের একমাত্র পেশা। এর মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

গোয়েন্দা পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে এলেও জিতুর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। কিন্তু হীরার বিরুদ্ধে শাহবাগ ও কোতোয়ালী থানায় দুটি মামলা রয়েছে।

সূত্র : জাগো নিউজ
এন এইচ, ১৪ আগস্ট

Back to top button