ব্যবসা

ভিয়েতনামে কারখানা বন্ধ থাকায় সুযোগ দেখছে বাংলাদেশ!

ঢাকা, ১১ আগস্ট – প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে। তারপর থেকেই একের পর এক দেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তবে করোনা মহামারির শুরু থেকেই কঠোর বিধিনিষেধের মাধ্যমে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এনে পুরো বিশ্বের নজর কেড়েছিল ভিয়েতনাম। সেই দেশটিই এখন ধুঁকছে করোনা সংক্রমণে।

চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এই দেশটিতে করোনার সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে সংক্রমণ ছিল একেবারেই কম। এমনকী প্রায় এক বছর সেখানে করোনা সংক্রমণে একজনেরও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। শুরু থেকেই সংক্রমণ রোধে গণহারে করোনা পরীক্ষা, বিভিন্ন জায়গায় মাস্কের ‘ফ্রি বুথ’ চালু করা, ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেই কোয়ারেন্টাইনে রাখাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ দেশটিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে।

কিন্তু করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেওয়া সেই ভিয়েতনামের পরিস্থিতিই এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৭। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪ হাজার ১৪৫ জন। সুস্থ হয়েছেন ৮০ হাজার ৩৪৮ জন।

অপরদিকে দেশটিতে বর্তমানে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৪, যা বেশ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন করে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন কলকারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে বিশ্বের অন্যতম পোশাক ও জুতা উৎপাদনকারী দেশটিকে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে। একই সঙ্গে ভিয়েতনাম থেকে পণ্য নেয়া বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডও খুঁজতে শুরু করেছে বিকল্প পথ।

এক সময় করোনা সংক্রমণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা এমন একটি দেশের জন্য সাপ্লাই চেন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি একটি বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে গত বছর করোনা মহামারির মধ্যেও এশিয়ার অল্পকিছু দেশের মধ্যে ভিয়েতনাম ছিল অন্যতম যারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকী পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে সাফল্য দেখিয়েছে ভিয়েতনাম।

সম্প্রতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই তালিকায় প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে চীন। আর তৃতীয় অবস্থানে নেমেছে বাংলাদেশ। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছিল। ৯ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার জনসংখ্যার এই দেশটি যেভাবে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশকে টপকে গেছে তা নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়েছে। ২০২০ সালে ২ হাজার ৯শ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে ভিয়েতনাম। এসময় বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল দুই হাজার ৮শ কোটি ডলার। আগের বছর ছিল তিন হাজার ৪শ কোটি ডলার। সেবছর বাংলাদেশের তুলনায় ৩শ কোটি ডলার কম রপ্তানি করেছিল ভিয়েতনাম।

কিন্তু ভিয়েতনামের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি দেশটির অর্থনীতির গতিরোধ করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২ লাখের বেশি নতুন সংক্রমণ ধরা পড়েছে যা, রীতিমতো উদ্বেগের।

ভিয়েতনামের বৃহত্তম শহর হো চি মিনের পরিস্থিতি সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। গত ৯ জুলাই সেখানে কঠোর সামাজিক দূরত্ব জারি করা হয়েছে। শ্রমিক পরিবহন, আবাসন ও বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আনা হয়েছে। অ্যাডিডাস ও নাইকির মতো ব্র্যান্ডের জন্য জুতা তৈরি করে বিশ্বের অন্যতম জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাইওয়ানের পৌ চেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার চ্যাংশিন।

তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির কাছেও জুতা সরবরাহ করে। কিন্তু গত মাসে পৌ চেন ও চ্যাংশিন তাদের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। গত ১৪ জুলাই থেকে হো চি মিন শহরে নিজেদের কারখানার উৎপাদন বন্ধ রেখেছে পৌ চেন। তারা জানিয়েছে, অন্তত আগামী ৯ আগস্ট পর্যন্ত তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এই প্রতিষ্ঠানের অপর একটি ভিয়েতনামি প্ল্যান্টেও উৎপাদন কার্যক্রম কমিয়ে আনা হয়েছে। এই কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার যেসব নিয়মকানুন জারি করেছে তার সবকিছু মেনে অধিকাংশ শ্রমিকই কাজে যোগ দিতে পারছেন না। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

গত বছর ২৪ কোটি ৪০ লাখ জোড়া জুতা সরবরাহ করেছে পৌ চেন। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশই এসেছে ভিয়েতনাম থেকে। অপরদিকে গত মাসে তাইওয়ানের আরও একটি জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফেং তেই তাদের বেশ কিছু কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নাইকি বছরে যত সংখ্যক জুতা বিক্রি করে তার ছয় ভাগের এক ভাগ তাদের তৈরি। ভিয়েতনামের টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, দেশের গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল কারখানার ৩০ শতাংশের বেশি বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে ভিয়েতনামের এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান জাগোনিউজকে বলেন, ২০২০ সালে আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতি নেতিবাচক হওয়ায় অনেক অর্ডার বাতিল হয়। বায়ার বিকল্প পথ খোঁজায় সে সুযোগ কাজে লাগায় ভিয়েতনাম। আমাদের পোশাকখাতের মূল প্রতিযোগী যেহেতু ভিয়েতনাম পাশাপাশি দেশটিতে এখন করোনা পরিস্থিতিও উদ্বেজনক। এ সুযোগে আমাদের শিল্প-কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। একই সাথে বায়ারদের কাছে এটা তুলে ধরতে পারলে আরও অর্ডার আসবে।

অপরদিকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম জাগোনিউজকে বলেন, আমাদের দেশে এখন অনেক অর্ডার আছে। ভিয়েতনামে অর্ডার হওয়া কাজতো আর আসবে না। তবে বায়ার এলে আমরা বাছাই করে অর্ডার নেব, এ অপশন আমাদের তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগোনিউজকে বলেন, ভিয়েতনামে দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু কারখানা বন্ধ আছে। উত্তর-মধ্যসহ অন্য কারখানায় এখনও উৎপাদন আছে। বায়ারতো আর সবাই আসবে না, কিছু হয়তো মুভ করবে। সুযোগ এসেছে দরদাম করার। যেসব বায়ার আসবে তাদের থেকে দরদাম করেই অর্ডার নেব। তবে এখন ইউরোপ থেকে প্রচুর অর্ডার আসছে।

সূত্র: জাগো নিউজ
এম ইউ/১১ আগস্ট ২০২১

Back to top button