অন্যান্য

টোকিও অলিম্পিকস: পদক জেতার জন্য বিভিন্ন দেশ যেভাবে তাদের অ্যাথলেটদের পুরস্কৃত করে

অ্যাথলেটদের অলিম্পিক পদক জয় করার পেছনে থাকে নানা ধরনের উৎসাহ উদ্দীপনা… যেমন সম্মান, মর্যাদা, কিছু অর্জন করা, খ্যাতি ইত্যাদি।

কিন্তু আপনি কি জানেন যে কিছু কিছু দেশ তাদের অ্যাথলেটদের পদক জয়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে আরো বেশি পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং এসব পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে নগদ অর্থ, বাড়ি, এমনকি গরুও?

প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি কোনো অর্থ প্রদান করে না, তবে অনেক দেশ তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব উস্কে দেওয়ার জন্য নানা ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করে থাকে।

এবারের টোকিও অলিম্পিকসেও অনেক অ্যাথলেট সোনার মেডেলের পাশাপাশি আরো অনেক উপহার পাবে তাদের নিজেদের দেশের কাছ থেকে।

দুটো নতুন বাড়ি

ফিলিপিনের ভারোত্তোলক হিদিলিন দিয়াজ ২৬শে জুলাই দেশটির জন্য অলিম্পিকে এই প্রথমবারের মতো সোনার মেডেল জয় করে তার দেশের জনগণকে আনন্দে ভাসিয়ে দেন।

নারীদের ভারোত্তোলনের ৫৫ কেজি ক্যাটাগরিতে সোনা জিতে তিনি পরিণত হয়েছেন জাতীয় নায়কে।

কিন্তু এই পদক জয় খেলার জগতের বাইরেও তার জীবনকে বদলে দিয়েছে।

হিদিলিন দিয়াজ ইতোমধ্যে ছয় লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পুরস্কার হিসেবে ফিলিপিন্স স্পোর্টস কমিশন এবং প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের দেওয়া অর্থও।

এছাড়াও তাকে দুটো নতুন বাড়ি দেওয়া হয়েছে। তার একটি বিলাসবহুল এক কন্ডো বা ফ্ল্যাট। চীনা-ফিলিপিনো এক ধনকুবের এন্ড্রু লিম ট্যাম তাকে এই পুরস্কার দিয়েছেন।

এই পরিমাণ অর্থ ও বাড়ি ফিলিপিনের এই নারীর জন্য নেহায়েত কম কিছু নয়। ফিলিপিনের বিমান বাহিনীতে সার্জেন্ট হিসেবে চাকরি করে প্রতি মাসে তিনি পান মাত্র ৫০০ ডলার।

অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার আগে প্রশিক্ষণের জন্য তার কোনো জিম ছিল না। বাড়িতে নানা রকমের যন্ত্রপাতি দিয়ে তিনি ভারোত্তোলনের অনুশীলন করেছেন। এর আগে তিনিসহ আরো কয়েকজন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেড় বছরের মতো মালয়েশিয়ায় আটকা পড়েছিলেন।

নগদ অর্থ পুরস্কার

একেক দেশে এই নগদ পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ একেক রকম।

সাধারণত যেসব দেশ সোনার পদক জিতে, তারা তাদের অ্যাথলেটদের অর্থ পুরস্কার দিতে তেমন একটা উৎসাহী হয় না। তবে এসব দেশের অ্যাথলেটদের প্রস্তুতির পেছনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্যেও থাকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা।

কিন্তু যেসব দেশ এখনও খুব বেশি পদক জিততে পারেনি, সেসব দেশের চিত্র অন্যরকম।

এখানে দুটো দেশের উদাহরণ দেওয়া যাক:

মালয়েশিয়ার মতো একটি দেশ, যারা ১৩টি অলিম্পিকসে এখনও পর্যন্ত ১১টি মেডেল জয় করেছে, তারা সোনার পদকের জন্য দুই লাখ ৪১ হাজার ডলার, রৌপ্য পদকের জন্য দেড় লাখ ডলার এবং ব্রোঞ্জের জন্য ২৪ হাজার ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছে।

টোকিও অলিম্পিকসে মালয়েশিয়া এখনও পর্যন্ত একটি পদক জয় করেছে। পুরুষদের ব্যাডমিন্টনের ডাবলসে তারা জিতেছে ব্রোঞ্জ মেডেল।

অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ, যারা ২৯শে জুলাই পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি পদক জিতেছে, তাদের অ্যাথলেটদের যে অর্থ পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে তা মালয়েশিয়ার চেয়ে অনেক কম।

টোকিও অলিম্পিকসে দেশটি ইতোমধ্যে ৪০টিরও বেশি পদক জয় করেছে।

চকচকে নতুন গাড়ি

অলিম্পিকসে পদক-জয়ী দেশগুলির মধ্যে ব্যতিক্রম চীন ও রাশিয়া। তাদের যেসব প্রতিযোগী মেডেল জয় করবেন, ঘোষণা করা হয়েছে যে পুরস্কার হিসেবে তাদের শুধু অর্থই দেওয়া হবে না, এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তরফেও তাদেরকে নানা ধরনের পুরস্কার দেওয়া হবে।

উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার কথা উল্লেখ করা যাক- এই দেশের অ্যাথলেটদের জন্য পদক জিতলে আছে আনকোরা নতুন গাড়ি এবং অ্যাপার্টমেন্টও।

গরু

তবে কিছু কিছু পুরস্কার আছে বেশ কৌতূহল উদ্দীপক।

যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার রোয়ার বা নৌকাচালক সিজু এনলভু, ম্যাথিউ ব্রিটেইন, জন স্মিথ এবং জেমস থম্পসন, যারা ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকসে পুরুষদের লাইট-ওয়েট ফোর ফাইনালে জিতেছেন, তাদের প্রত্যেককে একটি করে গরু পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

জ্যান স্ক্যানেল নামের একজন ব্যবসায়ী এবং টিভি শেফ তাদেরকে এই প্রাণীটি পুরস্কার হিসেবে দিয়েছেন।

নতুন চাকরি, বেশি বেতন

অলিম্পিকে পদক জয় করলে অনেক দেশে চাকরিও পাওয়া যায়। এমনকি তাদের বেতনও বেড়ে যেতে পারে।

যেমন ভারতের ভারোত্তোলক মিরাবাই চানু টোকিওতে রৌপ্য পদক জয়লাভ করার পর তাকে সাড়ে তিন লাখ ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি যে রেল বিভাগে চাকরি করেন, সেখানেও তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়াতে পদক-জয়ীরা বড় অংকের নগদ অর্থ পেয়ে থাকেন। কিন্তু পদক জিতলে পুরুষ অ্যাথলেটদের জন্য অন্য ধরনের পুরস্কারও থাকে- যেমন তাদেরকে সামরিক বাহিনীতে দেড় বছরের কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যা দেশটিতে সব পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক।

অর্থ, বাড়ি, গাড়ির চেয়েও বেশি কিছু

অলিম্পিকে মেডেল-জয়ী অ্যাথলেটদের পুরস্কৃত করার এই চল নতুন কিছু নয়। তবে ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সিঙ্গাপুরের সাঁতারু জোসেফ স্কুলিং-এর কথা ধরা যাক। ২০১৬ রিও অলিম্পিকসে পুরুষদের ১০০ মিটার ফ্লাই ইভেন্টে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তীসম সাঁতারু মাইকেল ফেল্পসকে পরাজিত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

জোসেফ স্কুলিং-এর এই বিজয়ের পর সিঙ্গাপুরের সরকার তাকে সাড়ে সাত লাখ ডলার দিয়ে পুরস্কৃত করে।

তবে অনেকের জন্যই এসব পুরস্কার তাদের জীবনে বড়ো ধরনের ভূমিকা পালন করে। তাদের বেশিরভাগই এমন সব স্পোর্টসে অংশ নেয় যেসবের ব্যাপারে মিডিয়ার তেমন একটা আগ্রহ থাকে না। একারণে অলিম্পিকের বাইরে তারা তেমন একটা স্পন্সরশীপও সংগ্রহ করতে পারে না।

উদাহরণ হিসেবে ব্রাজিলের অলিম্পিক অ্যাথলেটদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যারা সরকারি বৃত্তির ওপর নির্ভর করেন। তাদের মধ্যে যেমন একজন জিমন্যাস্ট রেবেকা অ্যান্ড্রেড, যিনি নারীদের ইভেন্টে দুটো পদক জিতে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন।

গ্লোবাল অ্যাথলেট নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৮টি দেশের অলিম্পিক প্রতিযোগীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এসময় তাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাদের প্রায় ৬০% বলেছেন যে আর্থিকভাবে তারা নিজেদের সচ্ছল বলে মনে করেন না।

বেশ কয়েকটি দেশের অ্যাথলেটরা, তাদের মধ্যে পদক-জয়ী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে, টোকিও অলিম্পিকসের আগে তাদের প্রস্তুতির জন্য জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ বিএমএক্স রেসিং অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন বেথানি শ্রিভারও তার স্বপ্ন পূরণের জন্য মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। কারণ নারী চালকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে অর্থ সাহায্য দেওয়া হতো সেটা ২০১৭ সালে কাটছাঁট করা হয়েছিল।

কোভিড মহামারির কারণে এবারের চিত্রটা আরো বেশি জটিল। কারণ এবার পুরস্কারের অর্থ বাতিল করা হয়েছে।

কিন্তু অনেক পদক-বিজয়ীকে, বিশেষ করে উপরে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদেরকে এজন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না, কারণ তারা তাদের নিজেদের দেশ থেকেই পুরস্কার পাচ্ছেন।

ভারোত্তোলক হিদলিন দিয়াজ যেমন পদক জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “মহামারি সত্ত্বেও আমরা এখানে এসেছি এবং দেশের জন্য মেডেল জয় করেছি। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।”

সূত্র : বিবিসি
এন এইচ, ০৭ আগস্ট

Back to top button