ব্যবসা

করোনা টিকায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে ৪০ লাখ পোশাককর্মী

রাজবংশী রায় ও আবু হেনা মুহিব

ঢাকা, ০২ আগস্ট – করোনা মহামারি বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থবির করে দিয়েছে। দেশে দেশে সংকট তীব্র হচ্ছে। ধনী-গরিব সব দেশের অর্থনীতিতেই করোনার প্রভাব পড়েছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো ধুঁকছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। এই হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ৫৩ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাইনাসে রয়েছে। প্রভাবশালী গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় সফল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উন্নয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল রয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮০ শতাংশ। এর নেপথ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। অথচ শুরুতে করোনার টিকাদানে অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল না এ খাতের কর্মীরা। তবে এখন তাদের টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ খাতের ৪০ লাখ কর্মী টিকায় অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। ঈদের আগে গাজীপুরে চারটি কারখানায় এ টিকাদান কার্যক্রম শুরুও হয়েছে। আজ সোমবার থেকে বড় পরিসরে অন্যান্য পোশাক কারখানায় টিকাদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।

পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতারা জানিয়েছেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪০ লাখ শ্রমিকের জন্য সমপরিমাণ টিকা সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে। এক মাস পর এসব কর্মীকে দ্বিতীয় ডোজের জন্য টিকার প্রয়োজন হবে। তখনও তারা টিকা পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পোশাককর্মীদের টিকাদানের লক্ষ্যে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর পক্ষ থেকে পৃথকভাবে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি পোশাক কারখানায় কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে সমন্বয় করে অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। সূর্যের হাসিসহ স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরাও পোশাককর্মীদের টিকাদানে সহায়তা দেবেন।

পোশাককর্মীদের মতো দেশের অন্যান্য রপ্তানি ও শিল্পকারখানার কর্মীদেরও জরুরি ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট খাতগুলোর নেতারা। তাদের মতে, দেশে রপ্তানি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ কর্মী কাজ করছেন।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখতে রপ্তানি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সুরক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। কর্মীরা সুরক্ষিত না থাকলে উৎপাদন কম হবে এবং অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অর্থনীতির স্বার্থে প্রবাসী কর্মীদের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও জরুরিভিত্তিতে টিকার আওতায় আনতে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।

দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি সচল রাখার নেপথ্যের উৎপাদনমুখী শিল্প খাতের বড় জনগোষ্ঠীকে জরুরি ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাদের অভিমত, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি লাখ লাখ কর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করলেও শিল্পকারখানার উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এ খাতের কর্মীদের সুরক্ষার অংশ হিসেবে জরুরি ভিত্তিতে টিকা দেওয়া প্রয়োজন। সরকার দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।

অন্য শিল্পকারখানার শ্রমিকরা টিকার বাইরে :বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যানুযায়ী, দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছয় কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে সরাসরি কর্মসংস্থানে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ছয় কোটি ৮০ হাজার। তাদের এক কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক শিল্প খাতে কাজ করছেন। পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর নেতাদের দাবির মুখে এ খাতের ৪০ লাখ শ্রমিক টিকা পেলেও অন্যান্য রপ্তানি ও শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বিষয়ে নিশ্চয়তা মেলেনি। সব কর্মীর জন্য টিকা পেতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নেতারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে লবিং-তদবির শুরু করেছেন। কিন্তু এখনও সাড়া মেলেনি।

এফবিসিসিআইর সভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, পোশাককর্মীদের পাশাপাশি সব ধরনের শিল্পকারখানার শ্রমিকদেরই টিকা পাওয়া উচিত। কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবার অবদান রয়েছে। সুতরাং তাদের সুরক্ষার অংশ হিসেবে টিকার আওতায় আনতে হবে।

শ্রমিকদের টিকার নিশ্চয়তা পেতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের তথ্য জানিয়ে জসিম উদ্দিন আরও বলেন, গত সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে তারা বৈঠক করে শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার কথা জানিয়েছেন। তবে দু-এক দিনের মধ্যে শ্রমিকদের জন্য টিকা চেয়ে তারা সরকারের কাছে লিখিত অনুরোধ জানাবেন। সরকার দ্রুততম সময়ে শ্রমিকদের টিকার ব্যবস্থা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সরকারের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা হয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা ৪০ লাখ টিকা পাচ্ছেন। এরই মধ্যে ২৯ হাজার প্রয়োগ করা হয়েছে। বাকিদের টিকা দেওয়া দু-এক দিনের মধ্যেই শুরু হবে।

তবে তৈরি পোশাক খাতের এক্সেসরিজ শিল্পের শ্রমিকদের টিকার আওতায় রাখা হয়নি। এ শিল্পে সাত লাখের মতো শ্রমিক কাজ করছেন। এক্সেসরিজ শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল কাদের খান বলেন, শ্রমিকদের জন্য টিকা বিষয়ে তারা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন; কিন্তু এখনও কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর কাছে টিকা সহায়তা চান ব্যবসায়ী নেতারা :পোশাক শ্রমিকদের জন্য টিকা এবং অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং ইইউ রাষ্ট্রদূতের কাছে সম্প্রতি পাঠানো পৃথক চিঠিতে এ সহায়তা চাওয়া হয়। পোশাক খাতে বাংলাদেশের বড় ক্রেতা হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশ কার্যালয়ের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে টিকা সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে সে দেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য সংগঠন দ্য আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ)। তৈরি পোশাক, পাদুকা শিল্পের উৎপাদন এবং আমদানিকারক এই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে এক চিঠিতে এই অনুরোধ জানানো হয়। গত ২৮ আগস্ট চিঠিটি দেওয়া হয়। চিঠিতে সংগঠনের প্রধান নির্বাহী স্টিভ ল্যামার বলেন, করোনার কারণে বাংলাদেশসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু বাণিজ্য অংশীদার দেশ সংকটে আছে। করোনার টিকার বৈশ্বিক সুষম বণ্টনের স্বার্থে এসব দেশকে টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা দেওয়া উচিত।

অন্য শিল্পের কর্মীদের জরুরি টিকা দেওয়া প্রয়োজন, মত বিশেষজ্ঞদের :পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পকারখানা কর্মীদেরও জরুরিভিত্তিতে টিকার আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পের অবদান রয়েছে। লাখ লাখ কর্মী এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। এই বেসরকারি খাতের মাধ্যমে বেকারত্ব সমস্যা দূর হচ্ছে। আবার তারা অর্থনৈতিক চাকাও সচল রাখছে। এসব শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে পড়লে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। সুতরাং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কর্মীদের সুরক্ষা প্রয়োজন। এ জন্য জরুরিভিত্তিতে তাদের টিকার আওতায় আনতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অর্থনীতির স্বার্থে ১৮ বছর ও তার ওপরের বয়সী সবার জন্যই টিকার ব্যবস্থা করা জরুরি। তবে শ্রমিকরা যেহেতু উৎপাদনশীলতার সঙ্গে জড়িত, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনতে হবে। তৈরি পোশাক শ্রমিকদের টিকা নিশ্চিত করা হয়েছে, এটা খুব ভালো কথা। তবে কোনো শিল্পের শ্রমিকদেরই টিকার বাইরে রাখা উচিত হবে না। এটা যেমন সুবিচারপূর্ণ নয়, তেমনি টিকা না পেলে শ্রমিকদের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হতে পারেন। তার মানে, সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাবে। মনে রাখতে হবে, করোনার মধ্যেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পেছনে শিল্প শ্রমিকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সুতরাং অবহেলা না করে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকার জনগণের টিকা নিশ্চিতকরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২১ কোটি ডোজ টিকার নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসবে। সুতরাং টিকা নিয়ে সংকট হবে না। টিকাপ্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সে অনুযায়ী টিকাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে ২৫ বছর ও তার ওপরের বয়সী সব নাগরিকের জন্য টিকার নিবন্ধন উন্মুক্ত করা হয়েছে। দেশের শিল্পকারখানার কর্মীদের সিংহভাগ এই বয়সসীমার আওতায় টিকা পাবেন। এর বাইরে যারা থাকবেন, তারাও ধাপে ধাপে টিকার আওতায় আসবেন বলে জানান তিনি।

সূত্র : সমকাল
এন এইচ, ০২ আগস্ট

Back to top button