প্রতারক ঈশিতা বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন
ঢাকা, ০২ আগস্ট – চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা নিজের ভুয়া ডিগ্রী, পদ ও পদবী প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আইপি চ্যানেল ব্যবহার করতেন। এসব প্রচারণার মাধ্যমে সে বিশিষ্ট আলোচকে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি তার ভূয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সকলকে বিভ্রান্ত করতেন। এছাড়া ফিলিপাইনের একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলারে সামরিক বাহিনীর মতো ‘বিগ্রেডিয়ার জেনারেল’ র্যাঙ্ক পদটি কিনেছিল। তাকে গ্রেপ্তারের পর এমন নানা ভয়ংকর তথ্য জানিয়েছেন র্যাব।
এর আগে, শনিবার ভোরে রাজধানীর মিরপুরে দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ভুয়া প্রতিনিধি পরিচয় দেওয়া প্রতারক ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদারকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি মানবাধিকার লংঘন, নারী শিশু অধিকার, চিকিৎসা বিজ্ঞান, করোনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচক হয়ে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অপচেষ্টা চালাতেন।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এছাড়াও তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সদস্য পদের ভূয়া সনদ তৈরী করে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।
ইশরাত রফিক ঈশিতার উত্থান
খন্দকার আল মঈন বলেন, ইশরাত রফিক ঈশিতা পেশায় একজন চিকিৎসক। যিনি বিভিন্ন মাধ্যমে একজন আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডি সম্পন্ন, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদ মর্যাদার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভূয়া পরিচয় প্রদান করে থাকেন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এসব ভূয়া পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তিনি ভূয়া নথিপত্র তৈরী ও প্রচার প্রচারণা করে থাকেন। তিনি ময়মনসিংহে একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-২০০৬) এমবিবিএস পাশ করেন। এরপর জুন ২০১৪ সালের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি একটি সরকারী সংস্থায় চুক্তি ভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে ০৪ মাস চাকুরী করার পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকুরীচ্যুত হন।
গবেষণায় ইশরাত রফিক ঈশিতার প্রতারণা
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, ইশরাত রফিক ঈশিতা চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তার ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রীগুলো হচ্ছে-এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি। এছাড়া ভুয়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করে থাকেন। ঈশিতা বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল বা থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা। তিনি মূলত অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিট করে বর্ণিত গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রস্তুত করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ইশরাত রফিক ঈশিতা জানান, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদেশ থেকে পাওয়া ভুয়া সাফল্য স্বীকৃতির প্রচারণা করতেন। ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (২০২০) পেয়েছেন, যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে বছরের ‘সেরা নারী বিজ্ঞানী’ হিসেবে পুরস্কার। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’, থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটষ্ট্যান্ডিং সায়েন্টিষ্ট এন্ড রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ইত্যাদি।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, ইশরাত রফিক ঈশিতা প্রতারণার মাধ্যমে ভূয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানীতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে নিজেকে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন বলে প্রচারণা করেন তিনি। এছাড়া তিনি অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আমেরিকান সেস্কুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুড উইল ইত্যাদি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তিনি অ্যাওয়ার্ড বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভূয়া ছবি ও সনদ তৈরী করে গণমাধ্যম ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, গ্রেপ্তার ইশরাত রফিক ঈশিতা করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিক প্রদান করে প্রচার-প্রচারণা করেছেন। সে বিভিন্ন বিদেশিদের ভুয়া সার্টিফিকেট প্রচারণা করে অন্যান্যদের অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট নিতে আকৃষ্ট করতেন।
ইশরাত রফিক ঈশিতার আন্তর্জাতিক প্রতারণা
র্যাব জানায়, ইশরাত রফিক ঈশিতা ইয়াং ওয়াল্ড লিডার ফর হিউম্যানিটি (‘Young World Leaders for Humanity’) নামক একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। অনলাইন প্লার্টফর্মে যার ফেসবুক পেজ ও লিংক আইডি রয়েছে। এ সংস্থাটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচারণা করা হয়েছে। এসব ফেসবুক পেজের কো-এ্যাডমিন গ্রেপ্তার ঈশিতা বলে জানিয়েছে র্যাব। এই ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরী করা হয়েছে।
এর মধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ হয়েছে। এছাড়াও এসব দেশগুলোকে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে গ্রেপ্তার ঈশিতা জানায়। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভূয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন র্যাব। ইতিমধ্যে বুরুন্ডি ও আফগানিস্তানে এ ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠনের ব্যানারে গত এপ্রিল ২০১৯ এ রাজধানীর একটি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০ জন বাংলাদেশীকেও ‘Young World Leaders for Humanity’ এর সম্মাননা জানানো হয়।
এছাড়াও তিনি জাতীয় সার্ভিকাল ক্যান্সার জোট (NCCC), বৈশ্বিক শুভেচ্ছা সংস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মানবতার জন্য তরুণ বিশ্ব নেতা, গ্লোবাল পিস চেইন, বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রকল্প, কাউন্টার ক্রাইম গোয়েন্দা সংস্থা, আন্তর্জাতিক পুলিশ কমিশন, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত বলে ভূয়া তথ্য প্রদান করে থাকেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
কে এই শহিদুল ইসলাম দিদার
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইশরাতের ‘বস’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদার ২০১২ সালে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা (ইঞ্জিনিয়ার) শেষ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি একটি গার্মেন্টেসে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। দিদারও ফিলিপাইনে একই সাইট থেকে টাকার বিনিময়ে ‘মেজর জেনারেল’ পদ কেনেন।
এছাড়া নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক), ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার কর হিউমিনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বা কর্ণধার হিসেবে পরিচয় দিতেন। একইভাবে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর পরিচয় দিতেন। এভাবে দেশে ও বিদেশে প্রতারণা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার প্রতারক ঈশিতা ও দিদার যোগসাজশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভুয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার ইশরাত রফিক ঈশিতা করোনা মহামারীকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিক প্রদান করে প্রচার-প্রচারণা করেছেন। সে বিভিন্ন বিদেশীদের ভূয়া সার্টিফিকেট প্রচারণা করে অন্যান্যদের অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট গ্রহণে আকৃষ্ট করতেন। গ্রেপ্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
সূত্র : বাংলাদেশ জার্নাল
এন এইচ, ০২ আগস্ট