চট্টগ্রাম

মিনুকে যাবজ্জীবন জেল খাটাতে দেড় লাখ টাকার চুক্তি করেন কুলসুমী

চট্টগ্রাম, ০২ আগস্ট – মাত্র দেড় লাখ টাকায় দফারফা করে নিরপরাধ মিনু আক্তারকে জেল খাটানোর ছক করে হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী ও তার সহযোগি মর্জিনা। তাদের এই মিশনে যুক্ত হন মো. নুর আলম কাওয়াল (৪৮) ও মো. শাহাদাত হোসেন নামে আরো দুই ব্যক্তি। তারা মিনু আক্তারকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মর্জিনার সাথে আদালতে পাঠায়।

রোববার (১ আগস্ট) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালতে হাজির করা হলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তারা।

এদিকে গত ৩১ জুলাই (শনিবার) রাতে জঙ্গল সলিমপুর কালাপানিয়া দরবেশ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে কুলসুমা আক্তার কুলসুমীর দুই সহযোগী মো. নুর আলম কাওয়াল (৪৮) ও মো. শাহাদাত হোসেনকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে মো. শাহাদাত হোসেনকে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে হাজির করা হলে আদালত ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ও মো. নূর আলম কাওয়ালকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এর আগে গত ২৯ জুলাই রাত ৩ টায় ইপিজেড থানাধীন ২ নম্বর মাইলের মাথা কমিশনার গলি থেকে মর্জিনা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। মর্জিনার তথ্যের ভিত্তিতেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ জানায়, রিমান্ডে থাকা আসামি কুলসুম আক্তার ও মর্জিনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, কুলসুম আক্তার হত্যা মামলায় ১ বছর ৪ মাস হাজত বাস শেষে জামিনে বের হয়ে দীর্ঘ ১০ বছর বিজ্ঞ আদালতে হাজিরা দেয়। পরে গত ৩০ নভেম্বর ২০১৭ এই মামলায় কুলসুম আক্তারর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হওয়ার পরই বিষয়টি আসামি মর্জিনা বেগমের সাথে আলোচনা করেন এবং সাজা থেকে বাঁচার জন্য মর্জিনাকে সহযোগিতা করতে বলে সে। আসামি মর্জিনা বেগম কুলসুমকে যাবজ্জীবন সাজা থেকে বাঁচানোর জন্য কুলসুম সাজার বিষয়টি নিয়ে আসামি মো. শাহাদাত হোসেন (৪২) এর সাথে আলোচনা করেন। আসামি মো. শাহাদাত হোসেন কুলসুমকে বাঁচানোর জন্য মো. নুর আলম কাওয়াল (৪৮) এর সাথেও আলোচনা করে। আসামি মো. নুর আলম কাওয়াল ও মো. শাহাদাত হোসেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কুলসুমের পরিবর্তে আরেক জনকে জেলখানায় পাঠাবে বলে মর্জিনাকে জানায়। কুলসুম বিষয়টি জানতে পেরে এক কথায় রাজি হয়ে যায়।

তাই মর্জিনা মিনুকে টাকার লোভ দেখিয়ে ও এক মাসের মধ্যে জামিন করিয়ে দেবে বলে তার সাথে চুক্তি করে। সেই অনুযায়ী গত ১২ জুন ২০১৮ মিনুকে কুলসুম সাজিয়ে মর্জিনা বেগমের সাথে আদালতে পাঠায়। হাজিরার দিনে আসামি মো. শাহাদাত হোসেন ও মর্জিনা বেগম মিনুকে আদালতে কুলসুম সাজিয়ে নিয়ে যায় এবং কুলসুম হিসেবে ডাক দেয়ার সাথে সাথে মিনু হাজতে ঢুকে যায়। পরবর্তীতে মিনু জেলখানায় যাওয়ার পর আসামি শাহাদাত হোসেন ও নুর আলম কাওয়াল মর্জিনা বেগমের কাছ থেকে পাওনা টাকা চাইলে মর্জিনা ও কুলসুম আক্তার টাকা যোগাড় করতে না পারায় কাল ক্ষেপণ করতে থাকে। এ টাকার জন্য শাহাদাত ও নুর আলম কাওয়াল মর্জিনা এবং কুলসুম আক্তারকে বার বার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, টাকা দিতে না পারায় স্থানীয়ভাবে সালিশী বৈঠকও করেন। একপর্যায়ে মর্জিনা এবং কুলসুম টাকা দিতে না পেরে ইপিজেড এলাকায় নিজেদেরকে আত্মগোপন করে রাখে বলে জানান পুলিশ।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজামউদ্দিন বলেন, কোহিনুর আক্তারকে হত্যার দায়ে আদালত সাজা দিয়েছিলেন কুলসুম আক্তারকে। কুলসুম নিজেকে বাঁচাতে মর্জিনার সঙ্গে পরার্মশ করে। পরে মর্জিনা তাকে শাহাদাত ও কাওয়াল নামে দুইজনের সন্ধান দেয়।

ওসি নেজাম বলেন, শাহাদাত ও কাওয়াল দুইজন দেড় লাখ টাকার চুক্তি করে নিরপরাধ মিনু আক্তারকে আদালতে পাঠায়। তাদের দুজনকে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাহাদাত হোসেনের ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে হাজির করা হলে আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন এবং কাওয়ালকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

প্রসঙ্গত, মোবাইলে কথা বলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জের একটি বাসায় ২০০৬ সালের জুলাইয়ে গলা টিপে হত্যা করা হয় গার্মেন্টসকর্মী কোহিনূর আক্তারকে। এরপর রহমতগঞ্জে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয় সেই মরদেহ। কোহিনুর আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন গার্মেন্টসকর্মী কুলসুম আক্তার।

তদন্তে বেরিয়ে আসে কোহিনুরকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারের জন্য গাছে ঝুলিয়ে রাখেন কুলসুম। ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কুলসুমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এক বছর তিন মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।

২০১৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন তখনকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক নুরুল ইসলাম। তাতে কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সে সময় কুলসুম পলাতক ছিলেন।

পরে আইনজীবী নাছির উদ্দীনের মাধ্যমে ২০১৮ সালের জুনে কুলসুম আত্মসমর্পণ করতে চান। আত্মসমর্পণের দিনই মিনুকে কুলসুম হিসেবে সাজিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। তখন থেকেই কারাগারে আছেন মিনু। নামের মিল না থাকার পরও কুলসুম আক্তারের বদলে মিনু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন দুই বছর নয় মাসের বেশি সময় ধরে।

কোনো কিছুর মিল না থাকায় একজনের স্থলে আরেকজন জেল খাটার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

সূত্র : বাংলাদেশ জার্নাল
এন এইচ, ০২ আগস্ট

Back to top button