ইস্টার্ন ওয়াটারওয়েজ গ্রিড বাংলাদেশ ভারত, ভুটান ও নেপালকে সুবিধা দেবে
নাটালিয়া স্টানকেভিচ, এরিক নোরা, অর্ণব বন্দ্যোপাধ্
ঢাকা, ০২ জুলাই – বিশাল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় সবচেয়ে পুরনো পরিবহন মাধ্যম হলো নদী। এক সময় এ অঞ্চলের পণ্য ও যাত্রী পারাপারের শতকরা ৭০ ভাগ সম্পন্ন হতো জালের মতো বিস্তৃত পানিপথগুলো দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে শতকরা ২ ভাগেরও কম পণ্য পরিবহন করা হয় পানিপথে। বাংলাদেশ এবং ভারত এই দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে অভিন্ন নদী ও নদীর অববাহিকা। দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে থাকা এসব নৌপথকে বর্তমানে আবার পুনরুজ্জীবিত করছে এই দুটি দেশ। একদিকে সড়কে যানজট, কার্বন নির্মাণ বাড়ছে, অন্যদিকে সড়কপথে খরচ বাড়ছে। এ জন্য এই অঞ্চলের ৩৫০০ কিলোমিটার নৌপথকে পরিবেশ উপযোগী এবং সস্তা মাধ্যম হিসেবে পরিণত করা হচ্ছে।
২০১৬ সালে ভারত পাস করে ন্যাশনাল ওয়াটারওয়েজ অ্যাক্ট।
তখন থেকেই তারা ন্যাশনাল ওয়াটারওয়েজ-১ এবং ২ হিসেবে গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদে সক্রিয়ভাবে উন্নয়নকাজ করেছে। নৌযোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে নতুন আরও কমপক্ষে ১০০ নৌপথ।
বাংলাদেশে মোট যাত্রীর প্রায় এক চতুর্থাংশ চলাচল করেন নদীপথে। আর কার্গোর শতকরা ৮০ ভাগ চলে নৌপথে। এখানে অভ্যন্তরীণ ৯০০ কিলোমিটার নৌপথের উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। এখন দুই দেশই বহু বিনিয়োগ ইস্টার্ন ওয়াটারওয়েজ গ্রিডে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের নদীগুলোকে আন্তঃসংযোগ দেয়া হবে। তারপর সেগুলোকে সড়ক ও রেলের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। পূর্বাঞ্চলীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার যথেষ্ট উপযোগিতা আছে এই গ্রিডের। এটা এ অঞ্চলের ৬০ কোটি মানুষকে লাভবান করবে।
ইন্দো-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটস (আইবিপি)-এর বিদ্যমান নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে এই গ্রিড। আইবিপি হলো সিরিজ নৌপথ, যাকে উভয় দেশই ট্রানজিট রুট বা একে অন্যের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে ইন্দো-বাংলাদেশ প্রটোকল ফর ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের অধীনে ১০টি আইবিপি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের এই প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে প্রথম ১৯৭২ সালে। তা ২০১৫ সালে সর্বশেষ নবায়ন করা হয়েছে।
চিকেননেক বলে পরিচিত পথের পরিবর্তে এসব রুট ব্যবহার করে ভারত তার পণ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অধিক দ্রুততা ও সস্তায় পৌঁছে দিতে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাশ দিয়ে এই চিকেননেক অতিক্রম করেছে। এটি হলো সরু একটি এলাকা। যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই পথটির দৈর্ঘ্য ১৬০০ কিলোমিটার।
আইবিপির সবচেয়ে ব্যস্ত রুট ব্রহ্মপুত্র নদ বরাবর। এই পথে পাথর, সিলিকন, পেট্রোলিয়াম, চা দেশের বাকি অংশে বার্জের মাধ্যমে পাঠায় ভারত। ভারতের পানিপথে প্রবেশের আগে এসব বার্জ প্রথমে আসামের ধুবরিতে বাংলাদেশের নদীতে প্রবেশ করে। এরপরে আবার ভারতের জলপথে প্রবেশ করে তা পৌঁছে যায় কলকাতা বা হলদিয়া বন্দরে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদ যমুনা হিসেবে পরিচিত। কার্গোগুলো অন্যপথ ব্যবহার করে। তারা অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পৌঁছে দেয়।
পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে সড়কপথে যে খরচ, এই রুটে তার চেয়ে দ্রুত এবং সস্তায় পণ্য পৌঁছে দেয়া যায়। পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত হলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় চেকপয়েন্ট। সেখানে সীমান্ত অতিক্রম করতে ট্রাকগুলোকে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়।
এটা উভয় দেশের জন্যই সমান সুযোগ। এর মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে আরও ভালোভাবে সংযুক্ত হতে পারে ভারত। অন্যদিকে বাংলাদেশ বন্দরের ফি, কার্গো হ্যান্ডেলিং এবং অন্যান্য সেবা থেকে আয় করে রাজস্ব। বাংলাদেশ এবং ভারতে সহজভাবে প্রবেশের জন্য কার্যকর পানিপথের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখা শুরু করেছে ভূভাগ দ্বারা অবরুদ্ধ নেপাল ও ভুটান। একই সঙ্গে তারা বঙ্গোপসাগরের বন্দরগুলোতে পৌঁছাতে চায়। এরই মধ্যে নির্মাণ শিল্পে ব্যবহারের জন্য নদীপথে বাংলাদেশে গুঁড়ো পাথর রপ্তানি শুরু করেছে।
অপার সম্ভাবনা: সড়ক পথে পণ্য পরিবহনে যে পরিমাণ খরচ হয়, নৌপথে খরচ তার এক পঞ্চমাংশ। এর ফলে পূর্বাঞ্চলীয় সাব-কন্টিনেন্টে বাণিজ্যকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে ইস্টার্ন ওয়াটারওয়েজ গ্রিড। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে তা বিশ্বের পঞ্চম সর্ববৃহৎ। তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ১০০০ কোটি ডলারের সম্ভাবনার নিচে অবস্থান করছে। নদীগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন হলে তাতে বহুবিধ সুবিধা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে বিপুল গার্মেন্ট শিল্পের জন্য কাঁচামাল, যেমন তুলা ভারত থেকে কমদামে আমদানি করতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে এই বাণিজ্য ভারতের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশাধিকার পাবে। এমনকি গঙ্গা নদী দিয়ে কার্গো পৌঁছে যেতে পারবে এলাহাবাদ ও বারানসি পর্যন্ত।
ভারতের দিক থেকে শিল্প-কারখানা বাংলাদেশ বেল্টে তাদের সুবিধা পেয়ে যাবে। তাতে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে স্থলপথের চেয়ে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ খরচ বাঁচবে। অন্যদিকে নৌ-যোগাযোগ উন্নত হলে তাতে নৌ-পথের পাশে টার্মিনাল, জেটি, কন্টেইনার ডিপো এবং গুদাম নির্মাণ হবে। এতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলো এতে সমৃদ্ধ হবে। সীমান্তের দু’পাড়ে তাতে গ্রিন ইকোনমিক জোন গড়ে উঠবে।
যখন এসব অভ্যন্তরীণ নৌপথ উপকূলীয় শিপিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে, তখন মিয়ানমারের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক করিডোর, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে উঠবে। তাতে এ অঞ্চলজুড়ে বহুবিধ প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশই এই গ্রিডকে সামনে এগিয়ে নিতে তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখিয়েছে। বাংলাদেশের শিপিং সেক্রেটারি মোহাম্মদ মিজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ভারতের সঙ্গে এসব রুটের প্রটোকল পুনরুজ্জীবিত করা, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য নদীভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক করিডোরের উন্নয়ন হলো আমাদের সরকারের অগ্রাধিকার।
জনগণের অপার সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে তুলে ধরেছেন ভারতের বন্দর, জাহাজ চলাচল ও নৌ-পথ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সঞ্জীব রঞ্জন। তিনি বলেছেন, এসব খাতে বিনিয়োগ যাতে জনগণের কাছে পৌঁছে সেটা নিশ্চিত করতে ভারত ও বাংলাদেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এসব মানুষ যাতে সহজে পণ্য পরিবহন করে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারেন, সে জন্য এসব করতে হবে। এই পানিপথগুলো তাদেরকে দেবে পরিবহন সুবিধা।
সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ বা মৈত্রী সেতু উদ্বোধন হলো একটি সঠিক পদক্ষেপ। উভয় দেশকে এখন পানিপথের সংযুক্তির বিষয়ে সীমাবদ্ধতাকে নমনীয়তার সঙ্গে সমাধান করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবহারকারীদের আস্থা বাড়াতে দ্বিপক্ষীয় প্রটোকল চুক্তি বৃদ্ধি, নৌ-চলাচলের মানদণ্ড এবং অপারেশনাল প্রটোকল এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য সহজ প্রক্রিয়া।
সূত্র : মানবজমিন
এন এইচ, ০২ জুলাই