জুলিয়ান মার্লে—এতটুকু বলার পর আপনার চোখে কার ছবি ভাসে? কিংবা আরও খানিকটা নির্দিষ্ট করে বললে কার গান কানে বাজে? উত্তর নিশ্চয়ই ঠোঁটের আগায় এসে গেছে—বব মার্লে। নামের শেষাংশের কারণেই এমন মিল খুঁজে পাচ্ছেন সন্দেহ নেই। জুলিয়ান ও ববের নামের মধ্যে মিল তো আছেই— পিতা-পুত্রের সম্পর্ক তাঁদের। তাঁদের মধ্যে আরেকটা মিলও বর্তমান। বব-পুত্র জুলিয়ান ঢাকায় গাইতে এসেছিলেন ২০১৩ সালে। সেবার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমরা। যথারীতি সাক্ষাৎকারের অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল বব মার্লেকেন্দ্রিক। অথচ দেখুন, জুলিয়ানও কিন্তু কম যান না। ২০০৯ সালে তাঁর অ্যাওয়েক অ্যালবামটি পেয়েছিল গ্র্যামি মনোনয়ন।
কিংবদন্তিতুল্য বাবা বব মার্লেকে নিয়ে এত প্রশ্ন যে হয়, আপনার কেমন লাগে? উত্তরে জুলিয়ান বলেছিলেন, ‘অবশ্যই ভালো লাগে, গর্ববোধ করি। আমি যদি বব মার্লের ছেলে না হতাম, তাহলে তো এই সুযোগটা পেতাম না!’
এটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার—বাবাকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি জুলিয়ান। এটা নিয়ে হয়তো তাঁর আফসোসও নেই। আবার যে গর্বের অনুভূতিটা আছে, সেটা তো একেবারেই নিজস্ব।
তারকার সন্তান তারকা হয়েছেন—দুনিয়ায় এমন অনেক উদাহরণ আছে। কেউ মা কিংবা বাবাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন। আবার কেউ কেউ মা-বাবার ছায়ার আড়ালে থেকে গেছেন আজীবন।
একটা কথা প্রচলিত আছে, বটবৃক্ষের ছায়াতলে আরেকটা বটবৃক্ষ বেড়ে উঠতে পারে না। আবার কেউ কেউ বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী হয়ে নিজের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছেন চারপাশে। উদাহরণ দিতে এবার দেশের বাইরে না গিয়ে আবুল হায়াতের পরিবারের কথাই বলা যাক। বিপাশা হায়াত—একাধিক পরিচয়ে পরিচিত। অভিনয়শিল্পী, লেখক, চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশের সেরা অভিনয়শিল্পীদের নাম বললে তাঁর কথা বলতেই হবে। যেমনটা বলতে হবে তাঁর বাবা আবুল হায়াতের নামও।
এবার একটু পাশের দেশে উঁকি মারা যাক। অমিতাভ বচ্চন আজও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। বলিউডের রাজা বললে কি কিছু কম হবে? আর তাঁর পুত্র অভিষেকের নামের আগে কোন বিশেষণটা জুড়ে দেবেন? নামের সঙ্গে তাঁর ক্যারিয়ারের অদ্ভুত মিল! দীর্ঘ ১৬ বছরের বলিউড যাত্রায় আজও তিনি যেন ‘অভিষেক’-পর্যায়েই ঘুরপাক খাচ্ছেন! বাবা অমিতাভ বলেই কি এমন দশা?
অভিষেকের কষ্টটা হাড়ে হাড়ে টের পান বাপ্পারাজ। বাংলা চলচ্চিত্রের এই অভিনয়শিল্পীর আরেকটা পরিচয় আছে, নায়করাজ রাজ্জাকের পুত্র তিনি। বাবার মতো বাপ্পাও ঢালিউডের পথে নেমেছেন। এই যাত্রার অভিজ্ঞতা কেমন? বাপ্পা বললেন, ‘তারকা-পুত্র হওয়ার অসুবিধাই বেশি। আমি যত যা-ই করি না কেন, সবাই বলেন, “আরে, ও তো রাজ্জাক সাহেবের ছেলে।” নিজের পরিচয়টা এখানে বাবার ছায়ায় হারিয়ে যায়। যেটা হয়েছে অভিষেক বচ্চনের ক্ষেত্রেও। তাঁর থেকে অনেক নিচুমানের অভিনেতাও বলিউডে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। ইতিবাচক দিকের কথা জিজ্ঞেস করলে বলব, কিছুই নেই! বাবা বিখ্যাত মানুষ বলে কোনো সুবিধা নেওয়ারও চেষ্টা করিনি। যা পেরেছি, নিজেই করার চেষ্টা ছিল।’
দেশ থেকে আবার পাশের দেশে ফিরে যাওয়া যাক। কলকাতার রায়-পরিবারের দিকে তাকান। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়—বাপ রে বাপ, একেকটা নামের সে কী ওজন! এই পরিবারের উত্তরসূরি সন্দ্বীপ রায় কি ততটা ‘ওজনদার’ হতে পেরেছেন? এ পর্যন্ত ২৮টির মতো টিভি নাটক ও সিনেমা পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ-পুত্র। যদিও অধিকাংশই বাবার সৃষ্টিকর্ম ঘিরে; তারপরও কি বাপ-দাদার নাম ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন তিনি? আচ্ছা, সন্দ্বীপ যদি সত্যজিতের পুত্র না হতেন, তাহলে কী হতো? প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে দেখুন না!
জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র কেয়ামত থেকে কেয়ামত-এ একটা গান ছিল, ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে/ সারা পৃথিবী তাকে মনে রাখবে/ শুধু এই কথা কেউ জানে না/ আগামী দিনের ঠিকানা...’। বাবামাত্রই সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করবেন, এটা কে না জানে? (একই কথা মায়েদের বেলায়ও প্রযোজ্য।) গানের কথা সমর্থন করে বলা যায়, আগামী দিনের কথা কেউ জানে না! ফলে তারকার সন্তান ভবিষ্যতে তারকা হবেন কি না, সেটা হয়তো নির্ভর করে প্রত্যেকের চেষ্টায়।
সবশেষে একটা কুইজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লেখালেখি করতেন। অন দ্য এজেস অব টাইম নামের একটি অপূর্ব আত্মজীবনী লিখেছিলেন তিনি। এর বাইরে তাঁর লেখা দু-তিনটি বইয়ের নাম বলুন তো?