নয়াদিল্লি, ১১ ফেব্রুয়ারী- শ্যুট-অফ শেষ হতেই ডোপবিরোধী দুই কর্মকর্তা তাঁকে ঘিরে ধরলেন। গেমসের নিয়ম অনুসারে ডোপ টেস্টের জন্য নিয়ে গেলেন শাকিল আহমেদকে। উত্তেজনায় তখন কাঁপছেন খুলনার তরুণ। কোচ সাইফুল আলম রিংকিকে সঙ্গে করে ডোপ পরীক্ষার ঘরে ঢুকলেন শাকিল।
কাহিলিপাড়ার পাহাড়ে ঘেরা শ্যুটিং রেঞ্জটা ততক্ষণে হয়ে উঠেছে এক টুকরো বাংলাদেশ। শ্যুটার, গণমাধ্যমকর্মী, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) কর্মকর্তারা খুঁজতে শুরু করে দিয়েছেন শাকিলকে। কক্ষের বাইরে থাকা শ্যুটারদের চোখেমুখে ঈদের আনন্দ। শাকিল বের হতেই শুরু হলো সেলফি তোলা, অভিনন্দনের জোয়ার। ভারত-পাকিস্তানের শ্যুটার, কর্মকর্তা, গেমসের সম্প্রচার চ্যানেল দূরদর্শনের সঞ্চালক এসে শুভেচ্ছা জানাতে লাগলেন। বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ে নতুন একটা ইতিহাসই গড়েছেন তরুণ শাকিল। ভারতীয় ওমপ্রকাশকে হারিয়ে ৫০ মিটার ফ্রি পিস্তল ইভেন্টে সোনা জিতেছেন উদীয়মান শ্যুটার। এর আগে ফ্রি পিস্তলে গেমসে কোনো সোনা জেতেনি বাংলাদেশ।
রেঞ্জটা আসাম পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটালিয়নের ভেতরে। একেবারে শেষ মাথায় পাহাড়ের ঢালে বিজয়মঞ্চ। সেখানে খানিক পরই উঠলেন শাকিল। উড়ল লাল-সবুজের পতাকা। বাজল জাতীয় সংগীত। শাকিলের হাত ধরে বাংলাদেশ জিতল গেমসের চতুর্থ সোনা।
শ্যুটিং যে একটা খেলার নাম, দুই বছর আগেও তা জানতেন না শাকিল! বাবা সাদেক আলী সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। বাবার পথ ধরে শাকিলও চাকরি নেন সেনাবাহিনীতে। শাকিলকে বেছে নিতে বলা হয় পছন্দের খেলা। অন্যসব প্রচলিত খেলা রেখে শাকিল বেছে নেন অস্ত্র আর গোলাবারুদের ‘অচেনা’ শ্যুটিং। তবে রাইফেল নয়, হাতে তুলে নেন পিস্তল। জাতীয় প্রতিযোগিতায় ফ্রি পিস্তলে একটি মাত্র ব্রোঞ্জ জেতা শাকিল নিজেকে চেনান দুই বছর আগে দিল্লিতে। সেবার এশিয়ান এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়রদের ব্যর্থতার মিছিলে একমাত্র ব্রোঞ্জটি জিতেছিলেন তিনিই।
শ্যুটিংয়ে এবারও ভারতের জয়জয়কার। এর ওপর এবার এসেছেন গগন নারাং, বিজয় কুমারদের মতো অলিম্পিক পদকজয়ীরা। সব মিলিয়ে ভারতের ছয়জন শ্যুটার খেলবেন ২০১৬ রিও অলিম্পিকে। এই দলটার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার আগেই তো মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকেন বাংলাদেশের শ্যুটাররা। তবে শাকিল কাল খেলেছেন নির্ভার হয়েই। শুরুতে বাছাইপর্বটা মোটেও মনের মতো হয়নি। ৫২০ স্কোর করে কোনোরকম সপ্তম হয়ে শ্যুট-অফে সুযোগ পান। শ্যুট-অফেই দেখা যায় শাকিল-জাদু। প্রথম চারটি শটে পিছিয়ে পড়লেও পঞ্চম শটে ১১৪.৮ স্কোর করে লিডারবোর্ডে সবার ওপরে উঠে আসেন। সেই ধারাবাহিকতাতেই জিতে নেন সোনা। স্কোরবোর্ডে ততক্ষণে শাকিলের নামের পাশে জমা হয়েছে ১৮৭.৬ পয়েন্ট। ভারতের ওমপ্রকাশ ১৮৭.৩ স্কোর করে রুপা ও পাকিস্তানের কলিমউল্লাহ খান ১৬৫.৯ স্কোর করে ব্রোঞ্জ জিতেছেন।
শাকিলকে দিয়েই যেন পিস্তলে নবযুগের সূচনা দেখছে বাংলাদেশ। রাইফেলের চেয়ে পিস্তলের গুলি তুলনামূলক ব্যয়বহুল। এ জন্য অতীতে পিস্তলের অনুশীলন হয়েছে কম। সাফল্যও সেভাবে ধরা দেয়নি। কিন্তু এবার ফেডারেশন এবং সেনাবাহিনী অনুশীলনে কার্পণ্য করেনি কোনো পক্ষই। সাফল্যও এল হাতেনাতে।
পদক নেওয়ার আগে মুঠোফোনে খুলনায় মা আসমা বেগমকে সুখবরটা দিলেন শাকিল। ওই প্রান্তে থাকা মা যেন বিশ্বাসই করতে চাইছিলেন না ছেলে কী কীর্তি গড়েছে! শাকিল হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘মা তো বিশ্বাসই করছেন না!’ শাকিলেরও বিশ্বাস হয়নি প্রথমে, ‘শুরুতে নার্ভাস লাগছিল। অনেক চেষ্টা করেছি নির্ভার থাকার। বাছাইয়ে বেশি ভালো করতে পারিনি। তবে খারাপ করায় মনের মধ্যে জিদ চলে এসেছিল। অন্য কিছু চিন্তা না করে নিজের খেলাটাই খেলে গেছি।’
বাংলাদেশকে সেই ১৯৯০ অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে সোনা জিতিয়েছিলেন আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনি। তবে তার পর থেকে পিস্তল ইভেন্ট কখনোই আলোচনায় ছিল না। শুধু রাইফেল ইভেন্টেই সোনা জিতেছে বাংলাদেশ। তাহলে কি নতুন যুগের শুরু হলো আপনাকে দিয়েই? শাকিলের মুখে সোনালি হাসি, ‘চেষ্টা করব ভালো কিছু করার।’ সেই ‘ভালো’র সীমানা নেই শাকিলের কাছে। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস হয়ে বিশ্বকাপে ওড়াতে চান লাল-সবুজের পতাকা।